alig-lagoদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আর মাত্র ১৭ দিন। এরই মধ্যে প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রতীক পেয়ে ভোটযুদ্ধে নেমেছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে অন্যতম বিরোধী দল বিএনপি অংশ না নিলেও এবার বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। ফলে নির্বাচনী মাঠ বেশ উত্তপ্ত। নির্বাচনকে সামনে রেখে আগে থেকেই আওয়ামী লীগ নেতাদের টার্গেট করেছে সন্ত্রাসীরা।

গত কয়েকদিন ধরে এর বিস্তার চরম আকারে বেড়ে গেছে। সরকারের শেষ বছরে গত ১০ মাসে আওয়ামী লীগের যেসব নেতা খুন হয়েছে গত কয়েকদিন এই ধারাবাহিকা চরম পর্যায় গিয়ে পৌঁছেছে। গত কয়েকদিনে প্রায় ৫ জন আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যা করা হয়েছে।

এদের মধ্যে, ১২ ডিসেম্বর পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার মুলাডুলি ইউনিয়নে নিখোঁজ হওয়ার দুইদিন পর আসাদুল ইসলাম এরশাদ (৩২) নামে এক স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার চোখ উপড়ানো মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। নিহত আসাদুল মুলাডুলি ইউনিয়নের শেখপাড়া রামনাথপুর গ্রামের হাবিবুর রহমান মুককাসের ছেলে। তিনি মুলাডুলি ইউনিয়নের ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক।

১১ ডিসেম্বর নোয়াখালীর এওজবালিয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. হানিফকে (২৪) নেতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। হানিফ দক্ষিণ শুল্লকিয়া গ্রামের মফিজ উল্যার ছেলে।

একই দিনে ফরিদপুরে বিএনপির হামলায় আওয়ামী লীগ নেতা নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। নিহতের নাম ইউসুফ আল মামুন। তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী ফরিদপুর-৩ (সদর) আসনে ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশররাফ হোসেনের কর্মী। মামুন নর্থ চ্যানেল ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন।

জানা যায়, সন্ধ্যার পর চায়ের দোকানে বসে রাজনৈতিক আলাপ আলোচনা করছিলেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ইউসুফ আল মামুন। এক পর্যায়ে বিএনপির সমর্থকরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ কথা বলতে থাকেন। এর প্রতিবাদ করেন মামুন। বাধে তর্ক। এক পর্যায়ে মামুনের উপর চড়াও হন বিএনপির সমর্থকরা। ক্রমাগত পেটানো হয় তাকে। তাকে বাঁচাতে গিয়ে আহত হন স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি লালন ফকিরও।

৪ ডিসেম্বর রাতে নওগাঁর পত্নীতলায় নিজ বাড়ির সামনে নৃশংসভাবে খুন হন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ইছাহাক হোসেন। সাবেক পৌর মেয়র ইছাহাক হোসেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। পার্টি অফিস থেকে রাতে বাড়িতে ফিরছিলেন তিনি। বাড়িতে প্রবেশের আগে দুর্বৃত্তরা তাকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। এতে তার প্রাইভেটকার চালকও আহত হন।

১ ডিসেম্বর রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার তাহেরপুর কলেজ গেটে ছুরিকাঘাতের শিকার হন তাহেরপুর পৌর যুবলীগের সহ-সভাপতি চঞ্চল কুমার। ওই দিন বিকেলে তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

একই দিনে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে খলিলুর রহমান শেখ (৫০) নামে তাঁতী লীগের এক নেতা খুন করা হয়। ওই দিন রাতে মোরেলগঞ্জ সদর ইউনিয়নের হরিণধরা গ্রামের সেলিম শেখের বাড়ির রাস্তার পাশে তার লাশ পাওয়া যায়। সাইকেল গ্যারেজ মিস্ত্রী নিহত খলিল মোরেলগঞ্জ পৌর তাঁতী লীগের সাবেক সদস্য সচিব ছিলেন। এছাড়া নভেম্বর মাসেও আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যায় তৎপর ছিল সন্ত্রাসীরা। এই মাসে ৪জন নেতাকে হত্যা করা হয়েছে।

৩০ নভেম্বর যশোরের বেনাপোলে আওয়ামী লীগের এক স্থানীয় নেতাকে বোমা মেরে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নিহত আমিরুল ইসলাম (৫০) বেনাপোলে উত্তর কাগজপুকুর গ্রামের মৃত লুৎফর রহমানের ছেলে ও বেনাপোল ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সদস্য।

২৮ নভেম্বর নাটোরের নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস গেটে লালপুর উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহারুল ইসলামকে কুপিয়ে খুন করে সন্ত্রাসীরা। দলীয় নেতাকর্মীদের অভিযোগ, খুনের আগে জাহারুলকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছিল।

২৬ নভেম্বর কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা ও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেনকে মাথায় গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। কুমিল্লার সামবক্সী এলাকার বল্লভপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে এ ঘটনা ঘটে। ১৭ নভেম্বর বগুড়ায় আদমদীঘি উপজেলায় নজরুল সর্দার (৪৮) নামের এক আওয়ামী লীগ নেতাকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে।

২৭ অক্টোবর বরগুনা সদর উপজেলার চালিতাতলী এলাকায় খলিলুর রহমান (৬৫) নামে এক আওয়ামী লীগ নেতাকে শ্বাসরোধে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। গভীর রাতে ঘরের সিঁধ কেটে প্রবেশ করে তাকে হত্যা করে। খলিল বরগুনা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি।

নিহতের স্ত্রী লিলি বেগম জানান, রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে সিঁধ কেটে বোরকা পরিহিত চার পাঁচজন লোক তাদের ঘরে ঢুকেন। এসময় তার স্বামী ও তিনি ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন। ঘুমন্ত অবস্থায় প্রথমে তার পরে স্বামী খলিলুর রহমানের হাত পা ও মুখমণ্ডল বেঁধে ফেলেন।

২৫ অক্টোবর গাজীপুরের শ্রীপুর পৌর শ্রমিক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ওমর ফারুককে (২৭) কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নিহত ওমর ফারুক শ্রীপুরের কেওয়া পশ্চিমখণ্ড গ্রামের বহেরার চালা এলাকার হাফিজুল ইসলামের ছেলে ও শ্রীপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল হাসানের ভাতিজা।

৩ অক্টোবর সিরাজগঞ্জ পৌর এলাকায় রানীগ্রাম মধ্যপাড়া মহল্লায় ৭ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি গোলাম মোস্তফাকে (৪০) হত্যা করা হয়। রানীগ্রাম বাজারের চায়ের দোকানে কয়েকজন দুর্বৃত্ত হামলা চালিয়ে মোস্তফাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করে। তাঁকে তাৎক্ষণিক হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

১ অক্টোবর বাগেরহাটে আওয়ামী লীগের দুই নেতাকে করা খুন হয়। জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলার দৈবজ্ঞহাটি ইউনিয়ন পরিষদে দৈবজ্ঞহাটি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনছার আলী দিহিদার (৫৩) ও আওয়ামী লীগ কর্মী শুকুর শেখকে (৪২) হত্যা করা হয়।

৩১ আগস্ট রাতে সিলেটে ছুরিকাঘাতে এসএম আবদুল আহাদ নামের এক আওয়ামী লীগ নেতা খুন হয়েছেন। নগরীর জিন্দাবাজার এলাকার সিটি সেন্টারের সামনে এ ঘটনা ঘটে। নিহত এস এম আবদুল আহাদ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কুয়েত শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক এবং সিলেট বিভাগীয় লেখক ফোরাম কুয়েত শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

১৫ আগস্ট কক্সবাজারের মহেশখালীর আওয়ামী লীগ নেতা ও ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ উল্লাহর বিরুদ্ধে যুবলীগ নেতা জিয়াবুলকে খুন করার অভিযোগ উঠেছে। নিহত জিয়াবুল মাতারবাড়ি ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন।

১ জুলাই গোপালগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও ইটভাটা ব্যবসায়ী আসাদুজ্জামান ওরফে টিটো শরীফ (৪৪) নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন। এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও গলা কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করে হত্যাকারীরা পালিয়ে যায়।

৩ জুলাই ময়মনসিংহের ত্রিশালে আ. মতিন মাস্টার (৬৫) নামে এক মুক্তিযোদ্ধার গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তিনি উপজেলার মঠবাড়ী ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি ছিলেন।

৯ জুলাই প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলায় আওয়ামী লীগ নেতা মশিউর রহমান বাবু (৪৫) নিহত হন। তিনি নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার আড়ানগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি।

৫ জুন চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ গল্লাক আদর্শ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ, মহিলা আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শাহিনা সুলতানা ফেন্সি (৫৭) খুন হন। শহরের ষোলঘর পাকা মসজিদের দক্ষিণ পাশে নিজস্ব বাসভবন থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

১৮ জুন নেত্রকোনা সদর উপজেলার মৌগাতি ইউনিয়নের বাদেবহর গ্রামের ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি হারেছ মিয়া দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে খুন হয়েছেন।

১৩ মে খুন হয়েছেন যশোর জেলা তরুণ লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ মনিরুল ইসলাম (৩৮)। শহরের পালবাড়ি মোড়ে কুপিয়ে ও বোমা মেরে মনিরুল ইসলামকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় সস্তোষ ঘোষ (৩৫) নামের অপর এক যুবক আহত হন। ৪ এপ্রিল রাঙ্গুনিয়ায় সাবেক যুবলীগ নেতা আবুল হাশেম প্রকাশের দ্বগ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়।

২৮ মার্চ কুমিল্লার তিতাসে একটি হত্যার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে খুন করা হয় আওয়ামী লীগ নেতা মনির হোসেনকে। তিতাস উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও জগতপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি।

রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনকে ঘিরে পালিয়ে থাকা সন্ত্রাসীরা সক্রিয় হচ্ছে। পত্র-পত্রিকার তথ্যে দেখা গেছে অনেক সন্ত্রাসী জামিনে বের হচ্ছে। নির্বাচন ঘিরে এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে, তবে এবার আওয়ামী লীগ নেতাদের টার্গেট করেই একটি মহল সন্ত্রাসীদের সক্রিয় করছে। সময়ের সাথে পরিস্থিতি আরো ভয়ানক হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।