DSEদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে অস্থিরতা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করছে। তেমনি বাড়ছে লেনদেন। আর লেনদেন বাড়াকে কেন্দ্র করে বিনিয়োগকারীদের মাঝে আলোচনার শেষ নেই। বিনিয়োগকারীরা বর্তমান বাজার পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করছে। তেমনি বিনিয়োগকারীরা নতুন করে বিনিয়োগমুখী হওয়ার চিন্তা ভাবনা শুরু করছেন।

নতুন সরকার গঠনের পর বড় বিনিয়োগের চাহিদা তৈরি হয়েছে। এর জন্য ব্যাংকে ভিড় করছেন বৃহৎ উদ্যোক্তারা। তারল্য বাড়াতে ব্যাংকাররাও ছুটছেন আমানত সংগ্রহে। এদিকে মন্দা কাটিয়ে উল্লম্ফন হয়েছে পুঁজিবাজারে। সরকারের নীতি নির্ধারকসহ সব মহলে আন্তরিকতার ফলে বাজার কিছুটা স্থিতিশীলতার আভাস ছিল।

তবে বাজারের এ আভাসে পুরোপুরি এখনো দু:চিন্তা কাটছে না বিনিয়োগকারীদের। তারপর কিছুটা স্বস্তিতে তারা। কারন দীর্ঘ দিন পর বাজার কিছুটা স্থিতিশীলতার আভাসে বিনিয়োগকারীদের মাঝে স্বস্তির নি:শ্বাস ফিরে এসেছে। অনেকদিন পর পুঁজিবাজারে গতিশীলতার কিছুটা আভাস দেখা দিয়েছে। গত কিছুদিন ধরেই লেনদেনে একটু উর্ধমুখী ধারা দেখা যাচ্ছিল।

বাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা নির্বাচন পরবর্তী সময়ে পুঁবিাজারের বড় ধরনের উত্থানের পেছনে বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করেন। তার মধ্যে রয়েছে সরকারের ধারাবাহিকতা, ব্যাংকে আমানতের কম সুদহার, গতিশীল অর্থনীতি, বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন ও বিদেশি বিনিয়োগে প্রবৃদ্ধি।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, বাজারে গতি ফেরার মতো উপাদান বেশ কিছুদিন ধরেই বিরাজ করছে। এর মধ্যে মঙ্গলবার অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের বৈঠক এবং নেগেটিভ ইক্যুইটি সমস্যার সমাধানের সম্ভাবনার খবরে সবাই বেশ উজ্জীবিত হয়েছেন। গত বৃহস্পতিবারের বাজারে ছিল তারই প্রভাব।

এদিকে মহাধসের ৮ বছর পর পাঁচ ইস্যুতে নতুন করে পুঁজিবাজারে জোয়ার এসেছে। পুঁজিবাজারের নব্য জোয়ারে প্রায় ২৮ লাখ বিনিয়োগকারীর দেশি-বিদেশি, প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ মিলে বেশিরভাগই সক্রিয় হয়েছেন। আর তাদের দেখাদেখি চলতি বছরের ৯ দিনে ৬০ হাজার নতুন বিনিয়োগকারী বাজারে এসেছেন।

ইস্যুগুলোর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে: বড় ধরনের সংহিসতা ছাড়াই সারাদেশে একাদশ নির্বাচনের ভোটগ্রহন সম্পন্ন হওয়া। এর ফলশ্রুতিতে শন্তিপূর্ণভাবে মন্ত্রী-এমপিরা শপথ ও দায়িত্ব নিয়েছেন। অর্থমন্ত্রীসহ পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট অন্তত ২৫-৩০ জন ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, যারা পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ নেবেন বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।

দ্বিতীয়ত, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বস্ত্র খাতের কোম্পানিগুলোর শেষ অর্থবছরে ভালো মুনাফা হয়েছে। এর ফলে কোম্পানিগুলো সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে ভালো মুনাফা দেবে।

তৃতীয়ত, চীনা কনসোর্টিয়ামের বেশিরভাগ টাকাই স্টেকহোল্ডাররা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করছেন। পাশাপাশি আইসিবির ২ হাজার কোটি টাকার ফান্ডে ৭৫ শতাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হচ্ছে।

চতুর্থত, ডিমিউচ্যুয়ালাইজড ডিএসইর কৌশলগত বিনিয়োগাকারী চীনা কনসোর্টিয়ামের অধীনে থাকা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও চলতি বছরে বিনিয়োগ করবে। এর জন্য ডিএসই সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি সিএসই কর্তৃপক্ষও এ বছরই কৌশলগত বিনিয়োগকারীর কাছে শেয়ার হস্তান্তর করছে।

এছাড়াও নির্বাচনকে কেন্দ্র গত এক বছর ধরে আটকে থাকা হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ শুরু হবে। এতে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। তার কিছু প্রভাব পুঁজিবাজারে পড়বে। এর ফলে ২০১৯ সালে পুঁজিবাজার ভালো থাকবে বলে বাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান যেমন: ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই), চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই), ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ), বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ), ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাই বলছেন।

বিনিয়োগকারীরা মনে করছেন, ২০১০ সালের মতোই ২০১৯ সালে বাজারে বড় ধরনের উত্থান হবে। কারণ ২০১৯ সাল নতুন সরকারের প্রথম বছর, ২০১০ সালের পর থেকে থেমে থেমে চলা দরপতন বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারের দাম তলানিতে রয়েছে। এগুলোর দাম যৌক্তি পর্যায়ে আসবে। অন্যদিকে নতুন সরকারের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল পুঁজিবাজারবান্ধব ব্যক্তি।

তিনি আগের অর্থমন্ত্রীর চেয়ে বাজার ভালো বোঝেন, তাই বাজার যাতে ভালো থাকে সেদিকে ইতিবাচক উদ্যোগ নেবেন। এসব কারণে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ব্যাংক, বিমা, আর্থিক এবং ওষুধ ও রসায়ন খাতসহ বেশিরভাগ খাতের শেয়ারের দাম। আর তাতে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সূচক ও লেনদেন। এতে বিনিয়োগকারীরা হারানো ৫৮ হাজার কোটি টাকার বেশি পুঁজি ফিরে পেয়েছেন।

ডিএসই ও সিএসইর তথ্য মতে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত ১৮ ডিসেম্বর থেকে পুঁজিবাজারে উত্থান শুরু হয়েছে। এরপর মোট ১৫ কার্যদিবস লেনদেন হয়েছে। এরমধ্যে ১৪ দিন উত্থান হয়েছে। এতে কেবল ডিএসইতে প্রধান সূচক বেড়েছে ৫২১ পয়েন্ট। তার মধ্যে নির্বাচনের পরদিন অর্থাৎ ১ জানুয়ারি থেকে ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে সূচক বেড়েছে ৪১২ পয়েন্ট।

অপর বাজার সিএসইতে সূচক বেড়েছে ১ হাজার ৭৫৪ পয়েন্ট। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসেই বেড়েছে ১ হাজার ৩৩৩ পয়েন্ট। সূচক বাড়ার সঙ্গে লেনদেনও ৩১৪ কোটি টাকার গড় থেকে বেড়ে ১০২৪ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। ফলে দুই বাজারে বিনিয়োগকারীরা ৫৮ হাজার ৩১০ কোটি ৭ লাখ ৪৮ হাজার টাকার পুঁজি ফিরে পেয়েছেন। তার মধ্যে ডিএসইতে বিনিয়োগকারীরা ৩১ হাজার ৮৭২ কোটি ৯০ লাখ ৮ হাজার টাকা আর সিএসইতে ২৬ হাজার ৪৩৭ কোটি ১৭ লাখ ৪ হাজার টাকার পুঁজি পেয়েছেন।

সার্বিক বিষয়ে ডিএসইর সাবেক প্রেসিডেন্ট বর্তমান ডিবিএ’র প্রেসিডেন্ট শাকিল রিজভী বলেন, জাতীয় সংসদের ভোট নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা ছিলো। এটা কেটে গেছে, এখন বাজার ভালো হবে।

তার সঙ্গে একমত পোষণ করে ডিবিএ’র সিনিয়র সহসভাপতি শরীফ আনোয়ার হোসেন বলেন, এবার কেবিনেটে পুঁজিবাজার বান্ধব অর্থমন্ত্রী এসেছেন। তিনি বাজার ভালো রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন। ১৯৯৬ সালের একযুগ পর ২০০৯ সালের শেষ দিক থেকে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে পুঁজিবাজার ভালো ছিলো উল্লেখ করে আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী ছানাউল হক বলেন, ২০১০ সালের পর এক দশক পূর্তি হচ্ছে ২০১৯ সাল। সুতরাং এ বছর পুঁজিবাজার ভালো থাকবে, এটাই পুঁজিবাজারে মোটিভ।

ডিএসইর এমডি কেএএম মাজেদুর রহমান বলেন, নতুন বছর পুঁজিবাজার ভালো থাকবে। তার কারণ, বিদেশিরা এখন বিনিয়োগ করবেন। পাশাপাশি নতুন করে বিদেশিরা যাতে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হয় সেজন্য বন্ড মার্কেট, স্মলক্যাপ এবং ডেরিভেটিভস প্রোডাক্টসগুলো চালুসহ করা একগুচ্ছ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ডিসেম্বর মাসে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ২০১৯ সালে পুঁজিবাজার ভালো হবেই। একই কথা একাধিকবার বলেছেন, বিএসইর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খায়রুল হোসেন।