দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ঋণখেলাপি ব্যাংক পরিচালক শাস্তি বাড়াতে এবার উদ্যোগ নিচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এক ব্যাংকের পরিচালকরা অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের সঙ্গে যোগসাজশ করে একে অন্যের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা আর পরিশোধ করছেন না। এ ধরনের ঋণ আদায়ে বিদ্যমান আইনে খেলাপি ব্যাংক পরিচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি আইনে নেই।

তাই এ আইনের ১৭ ধারায় সংশোধন এনে ঋণখেলাপি ব্যাংক পরিচালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। খেলাপি ঋণ কমানোর উপায় নির্ধারণ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এ ছাড়া, ১৮৮১ সালের দ্য নেগোসিয়েটেবল ইনস্ট্রæমেন্ট অ্যাক্টের ১৩৮ ধারায় সংশোধন এনে খেলাপি গ্রাহকদের বিরুদ্ধে শাস্তি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে মন্ত্রণালয়।

ব্যাংকের কোন চেক ডিজওনার হলে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদন্ড ও চেকে উল্লেখিত পরিমাণ অর্থের তিনগুণ জরিমানার কথা বলা আছে আইনের এ ধারাটিতে। আদালতের ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে ১৫ শতাংশ অর্থ আগাম পরিশোধ করার বিধান রয়েছে। এটি বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করার উদ্যোগ নিয়েছে মন্ত্রণালয়। ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১৭ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক পরিচালক অন্য কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করলে যে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন ওই ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ওই খেলাপি পরিচালককে নোটিশ দেবে।

নোটিশ দেওয়ার দুই মাসের মধ্যে ঋণ পরিশোধ না করলে খেলাপি ব্যক্তি তার ব্যাংকে পরিচালকের পদ হারাবেন। কিন্তু ঋণখেলাপি পরিচালকরা পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় কোনো ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে এ ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী হয় না। দেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের বড় অংশই বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক। আইনি নিষেধাজ্ঞার কারণে তারা নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারেন না। ফলে পরিচালকরা অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের সঙ্গে নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ দিয়ে নিজেরা অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। এসব ঋণের বড় অংশই খেলাপি হলেও তা আদায় করার কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই।

এসব পরিচালকরা ঋণ নিয়ে খেলাপি হলেও তাদের ঋণখেলাপির তথ্য অন্য খেলাপি গ্রাহকদের মতো বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো-সিআইবিতে থাকে না। ফলে খেলাপি হয়েও নতুন করে ঋণ পেতে কোনো অসুবিধা হয় না ব্যাংক পরিচালকদের। স¤প্রতি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলাম বলেন, ‘এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপি হলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।

ব্যাংক কোম্পানি আইনের ধারা-১৭ অনুযায়ী এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার যে পদ্ধতি রয়েছে তা বাস্তবসম্মত নয়। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে নোটিশ জারি করে পরিচালক পদ থেকে অপসারণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যার প্রয়োগ হয় না বললেই চলে। এরূপ ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিআইবিতে তার নাম চিহ্নিত করার ব্যবস্থা থাকা দরকার। এ ছাড়া নেগোসিয়েটেবল ইনস্ট্রæমেন্টস অ্যাক্টের ১৩৮-এ উল্লিখিত অপরাধের জন্য জরিমানা ও সাজার পরিমাণ বাড়ানো প্রয়োজন।’

অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালে আবুল মাল আবদুল মুহিত বিভিন্ন সময় ব্যাংক পরিচালকদের পারস্পরিক যোগসাজশে ঋণ নেওয়া বন্ধ করার উদ্যোগের কথা বললেও সুনির্দিষ্ট কোনো উপায় খুঁজে পাননি তিনি। নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে আনতে কঠোর বার্তা দেন। ঋণ নেওয়ার সময় গ্রাহকরা যে সম্পত্তি বন্ধক বা জামানত রাখে, ঋণ দেওয়ার আগেই সার্ভেয়ার প্রতিষ্ঠান বন্ধকী সম্পত্তির মূল্য অনেক বাড়িয়ে ব্যাংকের কাছে উপস্থাপন করে বলে মনে করে অর্থ মন্ত্রণালয়।

এ প্রসঙ্গে মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণের জামানতের মূল্যায়নে জটিলতা এখন আরও বেড়েছে। জামানত হিসেবে ভূমির মূল্যায়নের অস্বচ্ছতার মাত্রা বেড়েছে। যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যাংক জমির মূল্যায়ন করে, তারা ঋণগ্রহীতার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বেশি দর দেখায়। শিল্পঋণ ও প্রকল্পঋণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মেশিনের দামও বাড়িয়ে দেখানোর মাধ্যমে বেশি টাকা ঋণ নেওয়া হয়।

এভাবে ঋণ নেওয়ার পর গ্রাহক খেলাপি হলে জামানতের সম্পদ বিক্রি করে ঋণের পুরোটা পাওয়া যায় না। বন্ধকী সম্পত্তি মূল্যায়নের সার্ভেয়ার প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা না থাকায় তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। তাই এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা গড়ে তোলার পক্ষে মত দিয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, অর্থঋণ আদালতে মামলার সংখ্যা অনেক বাড়ছে। এ অবস্থায় আদালতের বাইরে ব্যাংকের পক্ষ থেকে খেলাপি গ্রাহকের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে অর্থ আদায় করে মামলা নিষ্পত্তির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ব্যাংকগুলোকে। খেলাপি ঋণ আদায় জোরদার করতে ব্যাংক কোম্পানি আইন, অর্থঋণ আদালত আইনসহ অন্য কোনো আইনের কোনো ধারা সংশোধন করার প্রয়োজন আছে কি না, সে সম্পর্কে ব্যাংকগুলোকে ১৫ দিনের মধ্যে জানাতে বলেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।