মনির হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্তির পরেই বদলে যা নতুন কোম্পানিগুলোর পুরাতন ইতিহাস। তালিকাভুক্তির পরেই কোম্পানিগুলোর বাস্তব অবস্থা বিনিয়োগকারীদের সামনে ফুটে উঠে। কারণ, এসময় অডিটর ও ইস্যু ম্যানেজারের পরিয়ে দেওয়া খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসে কোম্পানি। অথচ তালিকাভুক্তির আগে কোম্পানিটির মুনাফা ও বিক্রির প্রবৃদ্ধি ছিল ঊর্ধ্বমুখী।

ইয়াকিন পলিমারের প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) প্রসপেক্টাস অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কোম্পানির পণ্য বিক্রিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩২ থেকে ৪৮ শতাংশ। ২০১৩ সালে কোম্পানিটির বিক্রি ছিল ২২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা, যা আগের বছরের চেয়ে ৪৮ শতাংশ বেশি। ২০১৪ সালে বিক্রি বাড়ে ৪১ শতাংশ। আর ২০১৫ সালে ৩২ শতাংশ বিক্রয় প্রবৃদ্ধি হয়।

এদিকে ইয়াকিন পলিমার দ্বিতীয় প্রান্তিকের (অক্টোবর-ডিসেম্বর’১৮) অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন মুনাফায় ধ্বস নামছে। তথ্যমতে, আলোচ্য সময়ে কোম্পানির শেয়ার প্রতি আয় হয়েছে ৩ পয়সা। আগের বছর একই সময়ে শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েছিল ৫ পয়সা।

ছয় মাসে(জুলাই-ডিসেম্বর,১৮) কোম্পানির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৩ পয়সা। আগের বছর একই সময়ে ইপিএস লোকসান ছিল ১৪ পয়সা (restated)।৩১ ডিসেম্বর,১৮ শেষে কোম্পানির শেয়ার প্রতি সম্পদ মূল্য (এনএভি) দাঁড়িয়েছে ১২ টাকা ৫৬ পয়সা।

একাধিক বিনিয়োগকারীরা বলছেন, বাজারে বেশ কিছু কোম্পানির ক্ষেত্রেই এমনটা দেখা যায়। কোম্পানিগুলো বাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে ভালো মুনাফা করে। তখন বিনিয়োগকারীরা কোম্পানির বিক্রি ও মুনাফা প্রবৃদ্ধি দেখে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু পরে কোম্পানির আয় ও মুনাফা কমতে শুরু করে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হন বিনিয়োগকারীরা।

এদিকে ব্যবসা স¤প্রসারণে যন্ত্রপাতি ক্রয়, কারখানা ও প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ এবং আনুষঙ্গিক ব্যয় নির্বাহের জন্য ২০১৬ সালের দ্বিতীয়ার্ধে পুঁজিবাজার থেকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে ২০ কোটি টাকা উত্তোলন করে ইয়াকিন পলিমার লিমিটেড। তবে আইপিওর পরের বছরেই থেকে টানা কোম্পানিটির উৎপাদনে বড় ধরনের ধস নেমেছে।

দেশে ১৭ ধরনের পণ্যে বাধ্যতামূলকভাবে পাটের বস্তা ব্যবহারের সরকারি নির্দেশনার কারণে কোম্পানিটির পিপি ওভেন ব্যাগের বিক্রি কমে গেছে। পাশাপাশি নতুন যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপনের জন্যও কারখানার একটি অংশে বর্তমানে উৎপাদনকাজ বন্ধ রয়েছে। সব মিলিয়ে মোট সক্ষমতার মাত্র এক-চতুর্থাংশ পর্যন্ত সদ্ব্যবহার করতে পারছে কোম্পনিটি, আইপিওর আগে যা ছিল ৭০ শতাংশের বেশি।

সাতক্ষীরার লাবসায় অবস্থিত ইয়াকিন পলিমারের কারখানা সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, কারখানা সচল থাকলেও উৎপাদন সক্ষমতার মাত্র ২৫ শতাংশ ব্যবহার করছে কোম্পানিটি। উৎপাদনে ধস নামলেও শ্রমিক ও কর্মকতা-কর্মচারীদের সংখ্যা আগের মতোই আছে। ফলে আয় কমার বিপরীতে ব্যয় কমছে না। কারখানার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই বছর ধরেই কোম্পানির পণ্যের চাহিদা কমছে। চাহিদা কমায় বিক্রিও কমেছে। এ কারণে উৎপাদন অনেক কমে এসেছে। বর্তমানে মোট সক্ষমতার ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ব্যবহার হচ্ছে, আইপিওতে আসার আগে যা ছিল ৭১ শতাংশ।

ইয়াকিন পলিমারের কোম্পানি সচিব মো. আখতারুজ্জামান বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে ১৭ ধরনের পণ্যে পাটের ব্যাগ ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আর এই ১৭টি পণ্যের মধ্যে অধিকাংশের মোড়কজাতকরণে এতদিন পিপি ওভেন ব্যাগের ব্যবহার হতো। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ইয়াকিনের উৎপাদিত ব্যাগের চাহিদা কমেছে। তাই উৎপাদনও কমে গেছে। বর্তমানে আগের যেসব কার্যাদেশ ছিল, সেগুলোর বাইরে নতুন করে কোনো ব্যাগ উৎপাদন করা হচ্ছে না।

তবে রফতানিযোগ্য ব্যাগের উৎপাদন অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া আইপিওর অর্থে কারখানায় পুরনো যন্ত্রপাতির বদলে নতুন যন্ত্রপাতি স্থাপনের কাজ চলছে। এ কারণে অনেক যন্ত্রপাতি বন্ধ রয়েছে। এটিও উৎপাদন কমার একটি কারণ। স্থানীয় কিংবা রফতানি বাজারে ক্রয়াদেশ বাড়লে কোম্পানি সহজেই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পারবে বলেও আশাবাদী মো. আখতারুজ্জামান।

উল্লেখ্য, ইয়াকিন পলিমারের উৎপাদিত ব্যাগ মূলত ধান, চাল, গম, চিনি, সার, সবজি ও ফলমূল, পেঁয়াজ, আদা, আলুসহ বিভিন্ন ধরনের শস্য, প্রাণীজ ও মৎস্য খাদ্য, গার্মেন্টস, টেক্সটাইল ও জ্বালানি খাতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি সরকারের পক্ষ থেকে হলুদ, মরিচ, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, ডাল, ধনিয়া, আলু, তুষ-খুদ-কুঁড়া, আটা ও ময়দা মোড়কজাতের ক্ষেত্রে পাটের ব্যাগের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়।

আর আগে থেকেই ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার ও চিনি এ ছয় ধরনের পণ্যে পাটজাত মোড়কের ব্যবহার আইন অনুযায়ী বাধ্যতামূলক ছিল। এদিকে উৎপাদন কমার প্রভাবে ইয়াকিন পলিমারের বিক্রি ও মুনাফাও কমছে।

প্রসঙ্গত, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অনুমোদনের পর গত বছর পুঁজিবাজার থেকে ২০ কোটি টাকা উত্তোলন করে ইয়াকিন পলিমার। ১০ টাকা অভিহিত মূল্যে ২ কোটি শেয়ার ছেড়ে এ অর্থ উত্তোলন করে তারা। এর মধ্যে কারখানার ভবন নির্মাণে ৫ কোটি ২৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ১৩ কোটি ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনার কথা জানায় কোম্পানিটি। ওই বছরের ১০ থেকে ২০ জুলাই চাঁদাগ্রহণ করে অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষে ২২ সেপ্টেম্বর দেশের উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেন শুরু হয় কোম্পানিটির।

আইপিও তহবিল ব্যবহারসংক্রান্ত প্রতিবেদন অনুসারে, চলতি বছরের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত কোম্পানিটি ৬৬ দশমিক ৮১ শতাংশ যন্ত্রপাতি স্থাপনের কাজ শেষ করেছে। ১০০ কোটি টাকা অনুমোদিত মূলধনের এ কোম্পানির বর্তমান পরিশোধিত মূলধন ৬৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। রিজার্ভ ১৬ কোটি ৩ লাখ টাকা। কোম্পানির মোট শেয়ারের ৩০ দশমিক ৫২ শতাংশ এর উদ্যোক্তা-পরিচালকদের কাছে, প্রতিষ্ঠান ১৬ দশমিক ৯৯ ও বাকি ৫২ দশমিক ৪৯ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে।