দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: শেখ হাসিনা দলের নেতৃত্বে থাকতে চাইছেন না। গত দেড় বছরে একাধিকবার দলের নেতাদেরকে জানিয়েছেন সে ইচ্ছা। বলেছেন, বিকল্প ভাবার কথা। আবার ‘এটাই আমার শেষ মেয়াদ’ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই বক্তব্যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা-কর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান রাজনীতির বাস্তবতায় শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই।

তিনি যেভাবে দক্ষতার সঙ্গে দল ও সরকার পরিচালনা করছেন, তা অন্য কারও পক্ষে করা অনেক কঠিন। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাদের তিনি ব্যক্তিগতভাবে চেনেন ও জানেন। প্রায় সবার ফোন নম্বর তার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। একই সঙ্গে মোট চারবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ও দুবার বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে তার অবস্থান সারা বিশ্বে দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হলে আরও সময় নিতে হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।

জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলেকে গত বুধবার দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এটি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার শেষ মেয়াদ। তিনি আর প্রধানমন্ত্রী হবেন না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, নতুনদের হাতে দায়িত্ব তুলে দিতে চান তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই বক্তব্যে আলোচনা হচ্ছে, তাহলে কী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নতুন চমক আসছে। আসন্ন আওয়ামী লীগের সম্মেলনে কী নতুন নেতৃত্ব আসবে- এটাই এখন সর্বত্র আলোচনা চলছে।

বিশিষ্ট গবেষক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন, এটা কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নয়। তবুও তার এই কথার মূল্য রয়েছে। তার প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা প্রচুর। তিনি দলের ও সরকারের অভিভাবক হিসেবে কাজ করতে পারেন।’

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য বলেন, ‘নেত্রীর বিকল্প নেই। তবে নতুন নেতৃত্বের দায়িত্ব দিতে চেয়েছেন- অর্থাৎ আগামীতে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে অনেক নতুন মুখ দেখা যাবে। কারণ প্রতিটি সম্মেলনেই নতুন মুখ আসে। এবার তার ব্যতিক্রম হবে না। তবে সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের মতে, এই মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতো দক্ষ রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রপ্রধান এশিয়া মহাদেশে নেই। তিনি যতদিন বেঁচে থাকবেন দায়িত্ব তাকে নিতেই হবে। তবে আগামীতে তিনি তারুণ্যনির্ভর দল ও সরকার গঠনের একটা ইঙ্গিত দিয়েছেন। সে প্রস্তুতি দলের আগামী ২১তম জাতীয় কাউন্সিল থেকেই শুরু করতে পারেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনা বার বার বুলেট ও গ্রেনেডের মুখ থেকে বেঁচে ফেরা বহ্নিশিখা। তিনি তাঁর জীবন বাংলার মেহনতি দুঃখী মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করেছেন। রাজনীতির মাধ্যমে মানুষের কল্যাণই তার রাজনীতির দর্শন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে হত্যার পর ১৯৮১ সালের শুরুতে দলের দায়িত্ব নিয়ে দলকে শুধু চারবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়ই আনেননি, দেশকেও এগিয়ে নিয়েছেন অনেক দূর। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে যেমন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি উদার গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি তিনি। তাঁর দক্ষ নেতৃত্বে দেশ সব দিক দিয়ে এগিয়ে গেছে।

বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে ‘এই মেয়াদই শেষ মেয়াদ’- কথাটি দেশের জনগণ সমর্থন করবে না। কারণ, তিনি দেশের গণমানুষের নেত্রী। তাঁর ইচ্ছে প্রকাশ করলেও জনগণের ইচ্ছের দাম দিতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর মনের কথাটাই বলেছেন। প্রত্যেক মানুষের একটা সময়ে অবসরে যাওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী যেমন তাঁর ইচ্ছে ব্যক্ত করেছেন, তেমনি দেশবাসীরও ইচ্ছে আছে। দেশের উন্নয়ন-অর্জনে ‘জনগণের অবিসংবাদিত’ নেত্রীকে দেশের সাধারণ মানুষ চায়। নেত্রীকেও জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে হবে। এই মুহূর্তে শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান বলেন, ‘নেতাকে অনুসারীরা অনুসরণ করে। কখনো কখনো অনুসারীরা নেতাদের একদিকে নিয়ে যায়। একটা পর্যায়ে গিয়ে নেতাকে অনুসারীদের ফলো করতে হয়। প্রধানমন্ত্রী যাই চান না কেন, সর্বশেষ দিন পর্যন্ত তাকে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

আমার বিশ্বাস এ নিয়ে আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতা-কর্মী এবং দেশের জনগণ আপস করবে না। ব্যক্তির চাওয়া না চাওয়া নিজস্ব ব্যাপার হলেও রাষ্ট্রনায়কদের কখনো কখনো জনগণের ইচ্ছায় চলতে হয়। জনগণ চায় আগামীতেও শেখ হাসিনা দল ও দেশের নেতৃত্ব দেবেন।’

১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ওই সময়ে জার্মানিতে থাকার কারণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরসূরি দুই কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। দীর্ঘদিন নির্বাসিত জীবন কাটান তারা। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত করা হয়। দেশে ফিরে এসে দলকে গোছাতে তিনি সারা দেশে সাংগঠনিক সফর করেন। দীর্ঘ ৩৬ বছর দলের সভানেত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন তিনি।

তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলেন বলেই রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। এই মুহূর্তে দল ও সরকার পরিচালনায় শেখ হাসিনার বিকল্প ভাবছেন না কেউ। বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য শেখ হাসিনা অপরিহার্য। আওয়ামী লীগের মেয়াদকালে গত দুই মেয়াদে যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে, তা নজিরবিহীন।

শেখ হাসিনার হাত ধরেই বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে এক বিস্ময় বিশ্ববাসীর কাছে। বর্তমানে বিদেশিরাও বাংলাদেশের সাফল্যের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। দেশে ও দেশের বাইরে ভিশনারি লিডার হিসেবে শেখ হাসিনার যে ঈর্ষণীয় সাফল্য তা এক কথায় অনন্য ও অসাধারণ। তাঁর বিকল্প নেই।

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বলেন, ‘এই মুহূর্তে তাঁর কোনো বিকল্প নেই। অবসর গ্রহণের কী এমন বয়স হয়েছে, মাত্র ৭২ বছর বয়স। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ ৯২ বছর বয়সে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। দেশের প্রয়োজনে, জাতির প্রয়োজনে তাকে আমাদের প্রয়োজন।’

দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর জাতি যখন অন্ধকারে ছিল, আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা দিশাহারা হয়েছিল, সে সময়ে দলের হাল ধরেন আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি দলের দায়িত্ব নিয়ে শুধু রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে প্রতিষ্ঠিতই করেননি, চারবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এনেছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশকে বিশ্বে মর্যাদাপূর্ণ দেশ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। শুধু আওয়ামী লীগের কোটি কোটি নেতা-কর্মীই নয়, দেশের সব মানুষ বিশ্বাস করে বাংলাদেশের উন্নয়ন, অগ্রগতির জন্য শেখ হাসিনার বিকল্প এখনো হয়ে ওঠেনি। শেখ হাসিনার বিকল্প কেবল শেখ হাসিনাই।’সুত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন