দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পণ্য বিক্রি ও নিট মুনাফায় ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ থেকে বিনিয়োগকারীরা পেয়েছেন ভালো মূলধনি মুনাফা। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত খাতের ৩০টি কোম্পানির একটি তালিকা করেছে। তালিকায় উৎপাদনমুখী বহুজাতিক কোম্পানি যেমন রয়েছে, একই সঙ্গে রয়েছে দেশীয় কোম্পানিও।

এসব কোম্পানির মধ্যে মুনাফায় শীর্ষে রয়েছে ওষুধ ও রসায়ন খাতের স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। চলতি ২০১৮-১৯ হিসাব বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে (জুলাই-মার্চ) স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের পরেই সবচেয়ে বেশি মুনাফা করেছে বিদ্যুৎ খাতের ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ইউপিজিডিসিএল) এবং প্রকৌশল খাতের কোম্পানি বিএসআরএম লিমিটেড।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ১৫ খাতের কোম্পানিগুলোর চলতি হিসাব বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এ তথ্য পাওয়া গেছে। তবে ব্যাংক, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বীমা কোম্পানির হিসাব বছর জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়ায় এগুলোকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি এক্ষেত্রে। হিসাব বছর ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায় বিবেচনায় নেয়া হয়নি তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকেও।

অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ সময়ে ওষুধ ও রসায়ন খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯৪২ কোটি ৫ লাখ টাকা মুনাফা হয়েছে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের। ১৫ খাতের তালিকাভুক্ত সব কোম্পানির মধ্যে এটি সর্বোচ্চ মুনাফা। তবে এ খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুনাফা প্রবৃদ্ধি হয়েছে ওয়াটা কেমিক্যালের, ২৬৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের নির্বাহী পরিচালক (হিসাব ও অর্থ) মো. কবীর রেজা বলেন, আমাদের রাজস্বের পরিমাণ বেশ বড়। আর বড় আকারের এ রাজস্ব থেকে ধারাবাহিকভাবে মুনাফা প্রবৃদ্ধি ধরে রাখাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং কাজ। গত হিসাব বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম ১৭ থেকে ১৮ শতাংশ বেড়েছে। পাশাপাশি টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমাদের ব্যয় বেড়েছে।

কিন্তু ব্যয় বাড়লেও ওষুধ প্রশাসনের অনুমতি না পাওয়ার কারণে আমরা ওষুধের দাম বাড়াতে পারিনি। তবে আমরা রাজস্ব ও মুনাফায় প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার জন্য বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। এর মধ্যে রয়েছে বিপণন বিভাগকে পুনর্বিন্যাস করে বড় ইউনিট থেকে ছোট ইউনিটে রূপান্তর। এটিকে আমরা স্ট্র্যাটেজিক বিজনেস ইউনিট (এসবিও) বলে থাকি। এর সুফলও আমরা পেয়েছি। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি হিসেবে আমরা সবসময়ই শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থের বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে এসেছি।

জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে আলোচ্য সময়ে সবচেয়ে বেশি মুনাফা করেছে ইউনাইটেড পাওয়ার, ৬২৯ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এ মুনাফা ১৫টি খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। তবে এ খাতে সবচেয়ে বেশি মুনাফা প্রবৃদ্ধি হয়েছে ডেসকোর, ১১০ দশমিক ৯০ শতাংশ।

এ বিষয় জানতে চাইলে ইউনাইটেড পাওয়ারের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) ইবাদত হোসেন ভূইয়া বলেন, বিদ্যুৎ খাত সরকারের অগ্রাধিকার তালিকার শীর্ষে রয়েছে। এ খাতের উন্নয়নে সরকারের পক্ষ থেকে অনেক ধরনের প্রণোদনা দেয়া হয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে এ খাতের প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

আমরা সব সময় ফান্ডামেন্টাল, গ্রোথ ও ডিভিডেন্ড পে আউট এ তিনটি জিনিসকে গুরুত্ব দিয়ে থাকি, যাতে করে শেয়ারহোল্ডাররা ভালো রিটার্ন পান। আমাদের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মেইনটেন্যান্স এমনভাবে করে থাকি যাতে করে এখান থেকে সর্বোচ্চটা পাওয়া যায়। পাশাপাশি দক্ষতার সঙ্গে আমরা ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করছি। এসব কারণে আমাদের রাজস্ব ও মুনাফায় ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

প্রকৌশল খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৫৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা মুনাফা হয়েছে বিএসআরএম লিমিটেডের। ১৫ খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে এটা তৃতীয় সর্বোচ্চ মুনাফা। যদিও চলতি হিসাব বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে এ খাতে সবচেয়ে বেশি ৮০০ শতাংশ মুনাফা প্রবৃদ্ধি হয়েছে মুন্নু জুট স্টাফলার্সের।

বিএসআরএম লিমিটেডের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) শেখর রঞ্জন কর বলেন, চলতি হিসাব বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে আমাদের রাজস্ব আয় বেড়েছে। তবে সুদ বাবদ ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে কর-পরবর্তী মুনাফা কিছুটা কমে গেছে।
কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৩৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা মুনাফা হয়েছে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের। আর এ খাতে সবচেয়ে বেশি ৮০৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ মুনাফা প্রবৃদ্ধি হয়েছে বঙ্গজের।

বিবিধ খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১০৬ কোটি ৭ লাখ টাকা মুনাফা হয়েছে বেক্সিমকো লিমিটেডের। এ খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৬৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ মুনাফা প্রবৃদ্ধি হয়েছে এসকে ট্রিমসের। ২০১৮-১৯ হিসাব বছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ভ্রমণ ও আবাসন খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুনাফা হয়েছে ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস লিমিটেডের, ৫২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। তবে এ খাতে সবচেয়ে বেশি ৭৯ দশমিক ৫০ শতাংশ মুনাফা প্রবৃদ্ধি হয়েছে পেনিনসুলার।

বস্ত্র খাতের কোম্পানিগুলোর মুনাফায় সবচেয়ে এগিয়ে আছে শাশা ডেনিমস লিমিটেড। হিসাব বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে কোম্পানিটির মুনাফা হয়েছে ৪৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। যদিও এ খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে আলোচ্য সময়ে সবচেয়ে বেশি মুনাফা প্রবৃদ্ধি হয়েছে এনভয় টেক্সটাইলের, ৮৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ।

শাশা ডেনিমসের কোম্পানি সচিব আসলাম আহমেদ খান বলেন, শাশা ডেনিমসের কাছে থাকা এর সাবসিডিয়ারি কোম্পানি শাশা গার্মেন্টসের ২৩ লাখ ৫০ হাজার শেয়ার বিক্রি করে ১২ কোটি টাকার মূলধনি মুনাফা হয়েছে। আর এই মূলধনি মুনাফা মূল কোম্পানির আয়ের সঙ্গে যোগ হওয়ার কারণে চলতি হিসাব বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে আমাদের মুনাফা বেড়েছে।

টেলিযোগাযোগ খাতে সবচেয়ে বেশি ৪০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা মুনাফা হয়েছে বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেডের (বিএসসিসিএল)। এ খাতে সবচেয়ে বেশি ৭৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ মুনাফা প্রবৃদ্ধিও হয়েছে এ কোম্পানির।

চলতি হিসাব বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে সিমেন্ট খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা মুনাফা করেছে প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলস লিমিটেড। আর এ খাতে সবচেয়ে বেশি ৪০ দশমিক ১৪ শতাংশ মুনাফা প্রবৃদ্ধি হয়েছে মেঘনা সিমেন্টের। কাগজ ও প্রকাশনা খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকা মুনাফা হয়েছে বসুন্ধরা পেপার মিলস লিমিটেডের।

বসুন্ধরা পেপার মিলসের কোম্পানি সচিব এম নাসিমুল হাই বলেন, সব খাতের ব্যবসায়ই একটা মন্দা সময় থাকে। আমাদের খাতে চলতি হিসাব বছরের তৃতীয় প্রান্তিকের ব্যবসায় কিছুটা মন্দা ছিল। তাছাড়া স্থানীয় বাজার ধরতে প্রতিযোগী কোম্পানিগুলো পণ্যের দাম কমিয়ে দেয়ার কারণে আমাদেরও সেভাবে দর সমন্বয় করতে হয়েছে।

এ কারণে আমাদের বিক্রির পরিমাণ বাড়লেও টাকার অঙ্কে তা কমে গেছে। তবে বর্তমানে আমাদের ব্যবসা স¤প্রসারণের কাজ চলছে। স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি বিদেশে রফতানির বিষয়টিকেও আমরা সমানভাবে গুরুত্ব দিচ্ছি। আশা করছি, রফতানির পরিমাণ বাড়লে কোম্পানিটির রাজস্ব ও মুনাফায় ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আলোচ্য সময়ে সেবা ও আবাসন খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা মুনাফা হয়েছে ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের। আর এ খাতে সবচেয়ে বেশি ১১ দশমিক ৭১ শতাংশ মুনাফা প্রবৃদ্ধি হয়েছে শমরিতা হসপিটাল লিমিটেডের।

সিরামিক খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে এ সময় সবচেয়ে বেশি ২১ কোটি ৬ লাখ টাকা মুনাফা করেছে মুন্নু সিরামিকস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। সবচেয়ে বেশি ৩১৯ দশমিক ৫২ শতাংশ মুনাফা প্রবৃদ্ধিও হয়েছে কোম্পানিটির। চামড়া খাতে সবচেয়ে বেশি ২০ কোটি ৮১ লাখ টাকা মুনাফা হয়েছে ফরচুন সুজ লিমিটেডের। তবে এ খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৪০৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ মুনাফা প্রবৃদ্ধি হয়েছে লিগ্যাসি ফুটওয়্যার লিমিটেডের।

এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা মুনাফা হয়েছে আমরা নেটওয়ার্কস লিমিটেডের। আর এ খাতে সবচেয়ে বেশি ৫৯৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ মুনাফা প্রবৃদ্ধি হয়েছে ইনটেক লিমিটেডের। আর পাট খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকা মুনাফা হয়েছে নর্দান জুট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেডের।