দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধিতে এরইমধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সিমেন্ট কোম্পানিগুলোর ব্যবসায় বিপর্যয় ফুটে উঠেছে।বাড়তি ব্যয়ে ঝুঁকিতে পড়ছে সিমেন্ট খাত। কাঁচামাল, জ্বালানি ও পরিবহন ব্যয় বাড়ার কারণে আড়াই বছর ধরে সংকটে রয়েছে দেশের সিমেন্ট শিল্প। উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এ খাতের বেশিরভাগ কোম্পানির নিট মুনাফা কমেছে। ফলে সিমেন্ট শিল্পের তালিকাভুক্ত প্রায় সব কোম্পানিই শেয়ারদর হারিয়েছে।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আড়াই বছরে এ খাত ৪১ শতাংশ বাজার মূলধন হারিয়েছে। এ খাতের কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করে বড় অঙ্কের লোকসানে রয়েছেন শেয়ারহোল্ডাররা। সিমেন্টের কাঁচামাল ক্লিংকারের প্রায় পুরোটাই আমদানি করতে হয়। তিন বছরে ক্লিংকারের দাম বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। এই সময় জ¦ালানি ও গ্যাসের দামও হারে বেড়েছে।

পরিবহনে এক্সেল লোড নীতিমালা কার্যকরের কারণে এ শিল্পের ব্যয়ও বেড়েছে। সব মিলিয়ে উৎপাদন ব্যয় বাড়ায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে সিমেন্ট শিল্প। এতে কমে গেছে সিমেন্ট কোম্পানির নিট মুনাফা। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে এ শিল্পের কাঁচামাল আমদানি পর্যায়ে ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর ধার্যের কারণে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে খাতটি।

২০১৬ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সিমেন্ট খাতের বাজার মূলধন ৭ শতাংশ বেড়ে ১৫ হাজার ৪৯০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। এরপর থেকে এ শিল্পের মুনাফা কমতে থাকে। ২০১৭ সালে খাতটির মূলধন কমে ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। পরের বছর হারায় ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি বছর খাতটির নিট মুনাফায় সামান্য উন্নতি সত্তে¡ও ৩০ জুন পর্যন্ত প্রায় ১১ শতাংশ বাজার মূলধন হারিয়েছে। ফলে আড়াই বছরে খাতটির বাজার মূলধন ৪১ শতাংশ হারিয়ে ৯ হাজার ৩০ কোটি টাকায় নেমেছে।

উৎপাদন ব্যয় বাড়লেও বিক্রয়মূল্য বাড়ছে না সিমেন্টের। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন সক্ষমতা বেশি থাকায় তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে বিক্রয়মূল্য বাড়ছে না বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। প্রায় তিন কোটি টন চাহিদার বিপরীতে এ শিল্পের উৎপাদন ক্ষমতা সাড়ে ৫ কোটি টন।

উৎপাদন ব্যয় বাড়ার কারণে স¤প্রতি প্রায় প্রতিটি সিমেন্ট কোম্পানি তাদের উৎপাদিত পণ্যের দর বাড়িয়েছে। তবে এতেও সা¤প্রতিক বছরগুলোর মতো মুনাফার হারের ধারাবাহিকতা থাকবে কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। দেশে চাহিদার তুলনায় সিমেন্টের উৎপাদন সক্ষমতা বেশি থাকায় তীব্র প্রতিযোগিতাও রয়েছে। এর ফলে এক বছরে বস্তাপ্রতি সিমেন্টে প্রায় ৫৫ টাকা ব্যয় বাড়লেও বিক্রির ক্ষেত্রে একই হারে দাম বাড়াতে পারেনি সব কোম্পানি।

দেশের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি হাইডেলবার্গ সিমেন্ট। ২০১৭ সালের তুলনায় কোম্পানিটির উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ৪ শতাংশ। এ কারণে ২০১৮ সালে কোম্পানির নিট মুনাফা কমেছে সাড়ে ১১ শতাংশ। পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৬ সালে হাইডেলবার্গ সিমেন্টের নিট মুনাফা ছিল ১৫০ কোটি টাকা, যা ২০১৮ সালে ৮০ কোটি টাকায় নেমে আসে।

চলতি প্রথম প্রান্তিকেও কোম্পানির উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৪ শতাংশ। একই সময় বেড়েছে প্রশাসনিক, বিতরণ ও বাজারজাতকরণ ব্যয়। ফলে চলতি প্রথম প্রান্তিকে হাইডেলবার্গ সিমেন্টের নিট মুনাফা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩৬ শতাংশ কমে গেছে। নিট মুনাফা কমে যাওয়ায় হাইডেলবার্গ সিমেন্টের শেয়ারদরেও বিরূপ প্রভাব পড়েছে। দুই বছরে এ কোম্পানিটি ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশ বাজার মূলধন হারিয়েছে।

তালিকাভুক্ত সিমেন্ট কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংকট তৈরি হয়েছে কনফিডেন্স সিমেন্ট কোম্পানিতে। ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে উৎপাদন ব্যয় বাড়ে সাড়ে ৯ শতাংশ। একই সময় বাজারজাতকরণ ও সুদবাবদ ব্যয়ও বেড়েছে। আর এতেই পরিচালন লোকসানের মুখে পড়েছে কোম্পানিটি। যদিও ২০১৬-১৭ হিসাব বছরের তুলনায় ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে বিক্রি বেড়েছে প্রায় ৮ শতাংশ। অবশ্য চলতি হিসাব বছরে উৎপাদন ব্যয় কিছুটা বাড়লেও সংকট অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে।

সহযোগী প্রতিষ্ঠানের আয়ে চলতি তৃতীয় প্রান্তিকে নিট মুনাফা হয়েছে ২৮ কোটি ৯৭ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় সামান্য বেশি। চলতি হিসাব বছরে সংকট কাটিয়ে ওঠায় শেয়ারদরেও ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ক্লিংকারের একমাত্র নিজস্ব খনি রয়েছে লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ লিমিটেডের। হোলসিম বাংলাদেশ অধিগ্রহণের পর ২০১৮ সালে কোম্পানিটির বিক্রি বেড়েছে। নিজস্ব কাঁচামাল থাকায় উৎপাদন ব্যয়ও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে কোম্পানিটির।

এ কোম্পানির উৎপাদন ব্যয় হচ্ছে মোট বিক্রির ৭৫ শতাংশ, যা তালিকাভুক্ত অন্যান্য কোম্পানির চেয়ে কম। তবে কোম্পানিটি এখনো চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। ২০১৬ সালে এ কোম্পানির নিট মুনাফা ছিল ২২২ কোটি টাকা, যা পরের বছর ৮০ কোটি টাকায় নেমে আসে।

২০১৮ সালে কিছুটা উন্নতি হয়ে নিট মুনাফা ১১১ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। চলতি প্রথম প্রান্তিকেও উৎপাদন ব্যয় কিছুটা বাড়লেও বিক্রি বাড়ায় নিট মুনাফা ৫৫ শতাংশ বেড়েছে। তবে গত দুই বছরে এ কোম্পানি বাজার মূলধন হারিয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ।

২০১৭-১৮ হিসাব বছরে এম আই সিমেন্টের বিক্রি ৩৩ শতাংশ বাড়লেও উৎপাদন ব্যয় বাড়ার কারণে কোম্পানির মোট আয়ে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং এ সময় প্রশাসনিক, বিপণন ও বাজারজাতকরণ ব্যয় বাড়ায় কোম্পানির পরিচালন মুনাফা কমে যায়। সুদ ব্যয় বাড়ায় ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে এম আই সিমেন্টের নিট মুনাফা আগের বছরের তুলনায় ৫২ শতাংশ কমে যায়। চলতি তৃতীয় প্রান্তিকেও কোম্পানির পণ্য বিক্রি বেড়েছে।

তবে সুদ ব্যয় বাড়ায় নিট মুনাফা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৭ শতাংশ কমে গেছে। মুনাফা কমে যাওয়ায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) এ শেয়ারটি প্রায় ৩১ শতাংশ বাজার মূলধন হারিয়েছে। বেশিরভাগ সিমেন্ট কোম্পানি সংকটে থাকলেও মেঘনা সিমেন্টের বিক্রি ও নিট মুনাফা বাড়তে দেখা গেছে। গত দুই বছর ধরেই এ কোম্পানির বিক্রি বাড়ার পাশাপাশি নিট মুনাফাও বাড়তে দেখা গেছে।

চলতি তৃতীয় প্রান্তিকেও মেঘনা সিমেন্টের বিক্রি বেড়েছে ৩১ শতাংশ। উৎপাদন ব্যয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো পার্থক্য না থাকায় আগের বছরের তুলনায় চলতি তৃতীয় প্রান্তিকে এ কোম্পানির নিট মুনাফা বেড়েছে ৪০ শতাংশ। গত দুই বছরে এ কোম্পানিটি বাজার মূলধন হারিয়েছে ১৩ শতাংশ। ২০১৬ সালের পর থেকে দুই বছরে ২৪ শতাংশ বাজার মূলধন হারিয়েছে প্রিমিয়ার সিমেন্ট।

দেশের সিমেন্ট শিল্পের পরিস্থিতি নিয়ে এম আই সিমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুদ খান বলেন, সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল ক্লিংকারের ৯০ শতাংশের জোগান দেয় ভিয়েতনাম। চীনের চাহিদা বাড়ার কারণে গত আড়াই বছরে এ কাঁচামালের দর প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়েছে।

এছাড়া জ¦ালানি, গ্যাস ও পরিবহন ব্যয় বাড়ার কারণে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে। তবে বিক্রয়মূল্য না বাড়ায় সংকটের মধ্যে রয়েছে এ শিল্প খাত। এর মধ্যে আবার আমদানি পর্যায়ে ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর ধার্য করায় খাতটিতে বিপুল বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়বে।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৬ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সিমেন্ট খাতের বাজার মূলধন ৭ শতাংশ বেড়ে ১৫ হাজার ৪৯০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। এর পর থেকে এ শিল্পের মুনাফা কমতে থাকায় ২০১৭ সালে খাতটির বাজার মূলধন কমে ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। আর ২০১৮ সালে ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ মূলধন হারায়।

চলতি বছর খাতটির নিট মুনাফায় সামান্য উন্নতি সত্তে¡ও ৩০ জুন পর্যন্ত প্রায় ১১ শতাংশ বাজার মূলধন হারিয়েছে। এরফলে গত আড়াই বছরে সিমেন্ট খাতের বাজার মূলধন ৪১ শতাংশ হারিয়ে ৯ হাজার ৩০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।