দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক খাতের পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের অবসায়ন হচ্ছে এমন খবর প্রচারের পর থেকেই কোম্পানিটির করুণ অবস্থা তৈরি হয়েছে। গ্রাহকরা তাদের টাকা উত্তোলনের জন্য ঢাকার মতিঝিলের সিটি সেন্টারে অবস্থিত কোম্পানিটির অফিসে ভীড় জমিয়েছেন। অন্যদিকে কোম্পানির বিনিয়োগকারীরা স্টক এক্সচেঞ্জে তাদের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করার জন্য সেল অর্ডার দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু গ্রাহক ও বিনিয়োগকারী উভয়কেই নিরাশ হতে হচ্ছে।

এদিকে পিপলস লিজিং অবসায়ন বা বন্ধ হচ্ছে, তবে আমানতকারীদের আতঙ্ক হওয়ার কিছু নেই বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় চরম সংকটে থাকা পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস’র (পিএলএফএসএল) অবসায়নের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সিদ্ধান্তে আমানত ফিরে না পাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় আমানতকারীদের মধ্যে।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এক্ষেত্রে আমানতকারীদের কোনো সমস্যা হবে না। কারণ পিপলস লিজিংয়ের আমানতের চেয়ে সম্পদের পরিমাণ বেশি। গত বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংক পিপলস লিজিংয়ের অবসায়ন নিয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম এবং নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ শাহ আলম। তারা জানান, পিপলস লিজিংয়ের আমানতের তুলনায় সম্পদের পরিমাণ বেশি। তাদের আমানতের পরিমাণ দুই হাজার ৩৬ কোটি টাকা। বিপরীতে সম্পদ আছে তিন হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। এ কারণে আমানতকারীদের শঙ্কার কিছু নেই।

যে কারণে পিপলস লিজিং বন্ধ: অনিয়ম, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় চরম সংকটে থাকা পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের (পিএলএফএসএল) কার্যক্রম বন্ধের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে অনুমোদন দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। পিপলস লিজিংকে অবসায়ন করা হচ্ছে এ বিষয়টি স্বীকার করলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম এ সংক্রান্ত কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেন, বিভিন্ন মাধ্যমে আমি শুনেছি। ঠিক আছে কিন্তু এ বিষয়ে না জেনে কোনো মন্তব্য করতে পারব না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানায়, পিপলস লিজিংয়ে ঋণ বিতরণে অব্যবস্থাপনা, সম্পত্তির ঝুঁকি ও তারল্য সংকটে দুরবস্থায় রয়েছে। তারা আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে পরছে না। সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে স¤প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে চিঠি দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। চিঠিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনের ২২ (৩) এবং ২৯ ধারায় প্রতিষ্ঠানটি অবসায়নের উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়।

সম্মতি দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় গত ২৬ জুন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি দেয়। চিঠি পাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ অবসায়ন প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এজন্য প্রতিষ্ঠানটিতে আটকে থাকা আমানতের পরিমাণ, অনিয়মের ধরন, প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ও মাসিক বেতন-ভাতার পরিমাণ উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলছে।

২০১৪ সালের পর থেকে ডিভিডেন্ড দেয় নি পিপলস লিজিং: ব্যবসায়িক দুরবস্থায় ২০১৪ সালের পর থেকে ডিভিডেন্ড ঘোষণা করতে পারে নি পিপলস লিজিং। এরই ধারাবাহিকতায় ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তরিত হয় কোম্পানিটি। ৩১ ডিসেম্বর ২০১৫ সমাপ্ত অর্থবছরে কোম্পানিটির লোকসান হয়েছিল ৮৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।

পরবর্তী বছর অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ সালে কোম্পানিটির লোকসান হয়েছে ৪৯ কোটি ৩৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এদিকে, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ সালে কোম্পানিটির কর পরবর্তী মুনাফা হয়েছে ২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। কিন্তু ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮ সালে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েছে ৫.৫২ টাকা। শেয়ার সংখ্যার হিসাবে এ সময় কোম্পানিটির লোকসান হয়েছে ১৫৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।

পিপলস লিজিংয়ের প্রতি শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের দায় ৬৫.৫৯ টাকা: বিনিয়োগকারীরাই কোম্পানির মালিক। তাই মুনাফা করলে যেভাবে ডিভিডেন্ড পায় ঠিক একইভাবে লোকসান করলে দায়ও যায় বিনিয়োগকারীদের কাঁধে। ২০১৫ সালের পর থেকে ব্যবসায়িক দুরবস্থায় থাকা ও খেলাপি ঋণের নিচে চাপা পড়া পিপলস লিজিংয়ের শেয়ার প্রতি দায় ৬৫.৫৯ টাকা। অর্থাৎ কোম্পানিটির প্রতি শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের দায় ৬৫.৫৯ টাকা।

১০ টাকার শেয়ার ৩.৩০ টাকায় কিনছে না বিনিয়োগকারীরা: পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের প্রত্যেকটি শেয়ারের ফেসভ্যালু বা অভিহিত মূল্য ১০ টাকা। কিন্তু ব্যবসায়িক মন্দায় বিগত ১ বছরেও কোম্পানিটির শেয়ার ১০ টাকায় পৌঁছাতে পারে নি। “জেড” ক্যাটাগরির তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির শেয়ার টানা দর পতনে বর্তমানে ৩.৩০ টাকায় অবস্থান করছে।

বিগত ২ কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ার দর কমেছে ১৮.৩৩ শতাংশ। বুধবার দিনশেষে কোম্পানিটির শেয়ার দর কমেছে ৮.৩৩ শতাংশ বা ০.৩ টাকা। এদিন কোম্পানিটির শেয়ারে বিক্রেতা থাকলেও ক্রেতা সংকট ছিল লক্ষণীয়। দিনশেষে কোম্পানিটির ৭৩ হাজার ৮৬৩টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে।

অর্থ ফেরতের বিষয়ে আইনে যা আছে: সংশ্নিষ্টরা জানান, অবসায়ন হওয়া প্রতিষ্ঠানের আমানতকারীর অর্থ কোন উপায়ে ফেরত দেয়া হবে, সে বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনে কিছু বলা নেই। এক্ষেত্রে আদালত যে উপায়ে অর্থ পরিশোধ করতে বলবেন, তা কার্যকর হবে। তবে সাধারণভাবে সম্পদ বিক্রি এবং সরকারের সহায়তার আলোকে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়া হয়। এজন্য প্রথমে প্রতিষ্ঠানের দায় ও সম্পদ নিরূপণ করা হয়। এরপর একটি স্কিম ঘোষণা করা হয়। যেখানে নির্দিষ্ট মেয়াদ উল্লেখ করে কোন পরিমাণ আমানত কবে নাগাদ পরিশোধ করা হবে তার উল্লেখ থাকে।