দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজার অস্থিরতার নেপথ্যে মুন্নু সিরামিকস ও মুন্নু স্টার্ফলাস। এ কথা এখন বিনিয়োগকারীদের মুখে মুখে। নতুন সরকার গঠনের ছয় পেরিয়ে গেলেও শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। একদিন বাজার ভালো গেলে পরের দিনই খারাপ। এই পরিস্থিতির মধ্যে দিনের পর দিন অতিবাহিত হচ্ছে।

২০১৯ সালের শুরুতে অনেকটাই আশাবাদী ছিলেন পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা। অভিযোগ রয়েছে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত মুন্নু গ্রুপের শেয়ারের কারসাজির পর অস্বাভাবিক দরপতন শেয়ারবাজারকে আরও অস্থির করে তুলছে।

বাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুঁজিবাজারে একটি সিন্ডিকেট চক্র বাজারকে অস্থিতিশীল করতে কাজ করছে। এ অস্থিতিশীলতার নেপেথ্যে কারসাজি চক্র জড়িত। তারা অস্বাভাবিকভাবে মুন্নু সিরামিক ও মুন্নু জুট স্ট্যাফলার্সের দর বাড়িয়ে বিক্রি করে দিয়েছে। এখন কোম্পানি দুইটি বিনিয়োগকারীদের গলার কাঁটা। প্রতিদিনই বিনিয়োগকারীদের পকেট থেকে টাকা উধাও হচ্ছে।

একটি সূত্র জানায়, বিশেষ একটি গোষ্ঠী বিশেষ উদ্দেশে শেয়ারবাজারের দরপতনকে উস্কে দিচ্ছে। ওই গোষ্ঠীটি বড় বড় ব্রোকারেজ হাউসে গিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সামনে আরও বড় পতন হবে বলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ছেড়ে দিতে প্রলুব্ধ করছেন।

সাম্প্রতিক দরপতনের নেপেথ্যে মুন্নু সিরামিক ও মুন্নু স্ট্যাফলার্স কারসাজি চক্র জড়িত বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়। এ চক্রটি দরপতন বাজারকে উস্কে দেয়। ফলে ছয় মাসের মাথায় শেয়ার দর ২০০ শতাংশের বেশি কমেছে। জানা গেছে, ২০১৬ সালে কোম্পানির চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ মুন্নু মারা যাওয়ার পর কোম্পানি দুইটির দায়িত্বে আসেন তার মেয়ে বিএনপি নেতা আফরোজা খানম রিতা। তিনি বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা। কোম্পানির পর্ষদে এই পরির্বতন আসার পর থেকেই ৩৮ টাকার মুন্নু সিরামিক ৪৪১ টাকা ও ৪০০ টাকার মুুন্নু স্ট্যাফলার্স ৫৬৩৪ টাকা পর্যন্ত পৌঁছায়।

নতুন নেতৃত্ব আসার পর থেকেই কোম্পানির মুনাফা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দর বাড়তে থাকে। কিন্তু এক পর্যায়ে মুন্ন সিরামিক ও মুন্নু স্ট্যাফলার্স টানা দরপতন হয়। মুন্নু সিরামিকস ও মুন্নু স্ট্যাফলার্সের এ দরপতনে কোম্পানির পরিচালক থেকে শুরু করে কোম্পানির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা জড়িত। বাজারে গুজব রয়েছে মুন্নু সিরামিক ও মুন্নু স্ট্যাফলার্স বড় দরবৃদ্ধির পেছনে কোম্পানির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা হাত ছিল। এছাড়া একাধিক ব্যক্তি শ্রেণীর বড় বিনিয়োগকারী জড়িত ছিল।

জানা গেছে, গত ১৩ মার্চ মুন্নু সিরামিকের মুনাফায় উল্লম্ফন ও শেয়ার দরে অস্বাভাবিক উত্থান-পতনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালনা পর্ষদ। মুন্নু সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে কৃত্রিমভাবে মুনাফা ও শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) বাড়ানোর অভিযোগ উঠেছে।

এর মূল উদ্দেশ্য কোম্পানির একটি করপোরেট পরিচালকের শেয়ার বিক্রি। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বিরুদ্ধে মুন্নুর মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশে দায়িত্বহীনতার অভিযোগ তুলেছেন তারা। তাদের বক্তব্য, কোম্পানির দেয়া তথ্য কোন যাচাই-বাছাই না করে, অস্বাভাবিক মুনাফার বিষয়ে কোম্পানির কাছে কোন ব্যাখ্যা না চেয়ে ওই তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে ডিএসই।

জানা গেছে, মুন্নু সিরামিকের মুনাফার এই কৃত্রিম উল্লম্ফনে বাজারে শেয়ারের দামও তরতর করে বাড়তে থাকে। গত অর্ধবার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশের আগের কর্মদিবস তথা ২৭ জানুয়ারি বাজারে মুন্নুর শেয়ারের দাম ছিল ২৪৯ টাকা ২০ পয়সা। গত ৪ মার্চ কোম্পানির করপোরেট পরিচালক মুন্নু ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের শেয়ার বিক্রির ঘোষণার আগের দিন পর্যন্ত তা বেড়ে ৪৪১ টাকা ৩০ পয়সা হয়। ওই সময়ে এক মাসের ব্যবধানে শেয়ারটির দাম বাড়ে ৭৭ শতাংশ।

উল্লেখ, গত ৪ জানুয়ারি মুন্নু ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন ৭ লাখ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেয়। এটি বিক্রির পরই বাজারদরে আরও ২৮ লাখ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দিলেও সেটিও আর বিক্রি হয়নি। ব্যাপক সমালোচনার মুখে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ এই তথ্য প্রকাশ করে। অন্যদিকে মুন্নু স্ট্যাফলার্সের নামের কোম্পানিটিও মুন্নু ওয়েলফার ফাউন্ডেশনের নামে থাকা শেয়ার উচ্চ দরে বিক্রি করে বাজার থেকে টাকা তুলে নিয়েছে।

বাজার সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বাড়তি দামে পরিচালকের শেয়ার বিক্রি করার উদ্দেশ্য থেকেই কোম্পানিটি পরিত্যক্ত বা ওয়েস্টেজ জিনিস বিক্রির নামে বাড়তি আয় দেখিয়ে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের মূল্য বাড়িয়ে ছিলেন। এদিকে কোম্পানির একটি সূত্র জানায়, গত কয়েক মাসে মুন্নু সিরামিকের শেয়ারের পতনের পেছনে কোম্পানিটিতে অন্তর্কলহ প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করছে। এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকায় রয়েছে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অর্থ পরিচালকের দ্বন্ধ।

এই দ্বন্ধের জেরে অর্থ পরিচালক মুন্নু সিরামিক থেকে পদত্যাগও করেন। সবকিছু মিলে শেয়ারটির প্রতি বিনিয়োগকারীদের এক ধরনের আস্থাহীতা তৈরি হয়েছে। যার কারণে টানা পতনে রয়েছে কোম্পানি দুইটি।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজারের কিছু বড় বিনিয়োগকারী যোগসাজশ করে কোম্পানি দুটির শেয়ার দরে বড় বিপর্যয় ঘটিয়েছে। উল্লেখিত চক্রটি আবারও শেয়ার কারসাজির নতুন ফন্দি তৈরি করছেন বলে অভিযোগহ উঠেছে। বাজারকে অস্থির করার পেছনেও এসব বিনিয়োগকারীর হাত রয়েছে বলে তারা মনে করেন। বাজারের স্থিতিশীলতার স্বার্থে এসব অশুভ কারসাজি চক্রকে খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জোর দাবি জানিয়েছেন তারা।