দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: সদস্য সংগ্রহ কর্মসূচি সামনে রেখে দলে অনুপ্রবেশকারী ঠেকাতে এবার কড়া শর্তের আশ্রয় নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। তৃণমূলের প্রস্তাবেও ক্ষমতাসীন এ দলের নতুন সদস্য হতে হলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অনুমোদন লাগবে। অন্য কোনো দলের কেউ সদস্য হওয়ার আবেদন করলে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি।

বিভিন্নভাবে আবেদন যাচাই-বাছাই করে কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে সদস্য করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে নানা লাভের আশায় বিতর্কিত ও সুযোগসন্ধানীদের দলটিতে অনুপ্রবেশের সুযোগ কমবে বলে মনে করেন দলের নীতিনির্ধারকরা।

দলীয় সূত্র জানায়, সদস্য করার নতুন শর্তের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের সারা দেশের তৃণমূল ও স্থানীয় কমিটির ক্ষমতা খর্ব করছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। গত কয়েক বছরে তৃণমূলের নেতাদের মাধ্যমে দলে বেশি অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ আছে।

অনুপ্রবেশকারীদের আশ্রয় দিয়ে দলকে সমালোচনার মুখোমুখি করার সুযোগ তৃণমূলের কেউ যেন নিতে না পারেন, সেজন্যই নতুন সদস্য নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত তৃণমূলে না দিয়ে এখন থেকে সরাসরি কেন্দ্র থেকে বিবেচনা করা হবে।

তৃণমূলের কোনো নেতার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধী পরিবারের সদস্যরা যেন আওয়ামী লীগে ঢুকতে না পারেন, এমন উদ্দেশ্যও আছে দলের সদস্য নেওয়ার নতুন শর্তের পেছনে। যুদ্ধাপরাধীদের সন্তান ও বিতর্কিত পরিবারের সদস্যদের দলে না নেওয়ার সিদ্ধান্তে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কঠোর থাকবে।

এদিকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সূত্র জানায়, দুই কোটি সদস্য সংগ্রহের লক্ষ্যে এবার সদস্য সংগ্রহ কর্মসূচি শুরু করছে আওয়ামী লীগ। ‘তারুণ্যের শক্তি, বাংলাদেশের সমৃদ্ধি’ নীতির আলোকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শভিত্তিক আগামী প্রজন্ম গঠনে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়াতে দলের সদস্য সংগ্রহের সাংগঠনিক কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।

এবারের কর্মসূচিতে তরুণদের টানার লক্ষ্য ঠিক করেছে দলটি। প্রথম ভোটার হওয়া তরুণদের দলে টানতে আলাদা গুরুত্ব দেওয়ার পরিকল্পনাও আছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের। নবীন ও প্রবীণের মিশেলে দলকে আরো শক্তিশালী ও জনপ্রিয় করার লক্ষ্যেই এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে সরকারি দল।

এসব লক্ষ্যে গত কয়েক মাসের মধ্যে দলের বিভিন্ন জেলা পর্যায়ের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, প্রচার, তথ্য গবেষণা ও দপ্তর সম্পাদকদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতারা বৈঠকও করেন। বৈঠকে দলের গঠনতন্ত্রের বিষয়ে তূণমূলের নেতাদের জানানো হয়।

আগামী ২১ জুলাই থেকে সারা দেশে আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির কার্যক্রম শুরু হওয়ার জন্য নির্ধারিত হলেও তৃণমূলকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কঠোর নির্দেশনার কথা এর আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব বিষয় কীভাবে জনগণের কাছে প্রচার করতে হবে, এ বিষয়ে দলীয় কৌশলের নির্দেশনাও দেওয়া হয়।

কয়েকটি জেলার নেতাদের ঢাকায় ডেকে এনেও কেন্দ্রীয় নেতারা নির্দেশনার কথা জানিয়ে দেন। এ ছাড়া তৃণমূলে চিঠিও পাঠানো হয় কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পক্ষে। চিঠিতে দলের নতুন সদস্য সংগ্রহ ও পুরনোদের নবায়ন কার্যক্রমের অগ্রগতির তথ্য কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে জানাতে বলা হয়েছে। চলতি বছরের অক্টোবরে অনুষ্ঠেয় আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের আগেই দলের নতুন সদস্য সংগ্রহ অভিযান শুরুর বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে চিঠিতে বলা হয়েছে।

দলের গঠনতন্ত্র অনুসারে, তিন বছর পরপর একেবারে তৃণমূল থেকে শীর্ষ পর্যন্ত পুরনো সদস্যদের সদস্য পদ নবায়ন করার কথা। একই সঙ্গে ১৮ বছর বা এর বেশি বয়সীদের দলের নতুন সদস্য করার কথা বলা আছে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান এ প্রসঙ্গে বলেন, দলের কেন্দ্রীয় সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সদস্য সংগ্রহের কর্মসূচি আরো জোরদার করা হয়েছে। আগামী দিনের জন্য আওয়ামী লীগ নবীনদের দলে অন্তর্ভুক্ত করবে আর প্রবীণদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, কোনো অবস্থাতেই যুদ্ধাপরাধীদের সন্তান, সেই পরিবারের কোনো সদস্য ও বিতর্কিত পরিবারের সদস্যরা যেন আওয়ামী লীগে অন্তর্ভুক্ত হতে না পারেন, তা আমরা কেন্দ্র থেকে খুব সতর্কভাবেই দেখব। এটি আমরা খুব ভালোভাবেই কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে পর্যবেক্ষণ করব।

সূত্র জানায়, দলের নতুন সদস্য সংগ্রহ কর্মসূচির গতি বাড়াতে এবার শুরু থেকেই সচেষ্ট আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। গত দুবারের মতো জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের মধ্য দিয়ে শুরু হলেও হঠাৎ করে কার্যক্রম যেন গতিহীন হয়ে না পড়ে, এ বিষয়ে ক্ষমতাসীন দল এবার আগেভাগেই সতর্ক হয়ে তৃণমূলের প্রতি কঠোর নির্দেশ পাঠিয়েছে। কর্মসূচি বাস্তবায়নে তৃণমূলের নেতাদের অবহেলা ও কর্তব্যে ফাঁকি কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতাদের কাছে প্রমাণিত হলে প্রয়োজনে তাদেরকে দল থেকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে বলেও তৃণমূলকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের সূত্রমতে, টানা দশ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকাকালে দুবার দলের নতুন সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু হলেও কোনোবারই শেষ করতে পারেনি তৃণমূল আওয়ামী লীগ। ফলে সদস্য সংগ্রহে কেন্দ্রের দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা একবারও পূরণ হয়নি। মহা ধুমধামে উদ্বোধনের পরই নেতাকর্মীদের গা ছাড়া ভাবের কারণে গতি হারিয়ে ফেলে কর্মসূচি। দ্রুত ও কেন্দ্রের নির্দেশমতো কার্যক্রম শেষ করতে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের স্বাক্ষরিত চিঠি ও শীর্ষ অন্য নেতাদের নির্দেশ তৃণমূলে পৌঁছালেও কোনো কাজে আসেনি।

২০১৭ সালে দলের সদস্য সংগ্রহ অভিযান শুরু হলেও পরের বছর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের জোয়ারে তা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে যায়। ওই অভিযানের মধ্য দিয়ে নতুন ভোটারসহ দুই কোটি নতুন সদস্য করার টার্গেট ছিল আওয়ামী লীগের।

এর আগে ২০১০ সালে সদস্য সংগ্রহ অভিযান শুরু হলেও ওই বছরও তা বেশিদিন চলেনি। ২০১০ সালে অনেক জেলায় কার্যক্রম ঠিকভাবে চলেনি। কিছু জেলায় দায়িত্বশীল নেতা ছাড়া আর কেউ দলীয় সদস্যপদ নবায়নও করেননি। সোয়া দুই কোটি সদস্য করার লক্ষ্য নিয়ে ওই বছর কার্যক্রম শুরু করে দল। তারও আগে ২০০২ সালে আনুষ্ঠানিক সদস্য সংগ্রহ অভিযান চালায় আওয়ামী লীগ।

গত ৩০ জুন রাতে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপের স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আগামী ২১ জুলাই থেকে সারা দেশে নতুন ভোটারদের আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য হিসেবে অর্ন্তভুক্তির কার্যক্রম শুরু হবে।

২০১৭ সালের ২০ মে গণভবনে অনুষ্ঠিত বিশেষ বর্ধিত সভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের সদস্য পদ সংগ্রহ ও নবায়ন কার্যক্রম উদ্বোধন করার পর থেকে সারা দেশে দলের সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সংগঠনের প্রতিটি শাখায় নতুন ভোটারদের আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।