দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৮ কোম্পানি থেকে বিদেশী বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। ২০১৮ সাল থেকে পুঁজিবাজারে চলা মন্দায় স্থানীয় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের নিষ্ক্রিয়তার পাশাপাশি বিদেশিরাও পুঁজি প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। চলতি বছর টানা পাঁচ মাস শেয়ার বিক্রি করে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন বিদেশিরা।

এতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরবর্তী দুই মাস ইতিবাচক ধারা থাকার পরও চলতি বছর শেয়ার বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় নিট বিনিয়োগে ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। এর ফলে গত ১৯ মাসে ৬০০ কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ পুঁজিবাজার প্রত্যাহার করে নিয়েছেন বিদেশিরা।

মূলত ভালো শেয়ারের অভাব ও টাকার অবমূল্যায়ন না হওয়ায় বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ২০১৮ সাল থেকে সদ্য শেষ হওয়া জুলাই মাস পর্যন্ত ১৯ মাসের মধ্যে ১৪ মাসই শেয়ার ক্রয়ের চেয়ে বিক্রি বেশি ছিল।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কারণে ২০১৮ সালে বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির প্রবণতা দেখা যায়। এ সময় বিদেশিরা ৫৯৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকার বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেন। জাতীয় নির্বাচনে পূর্ববর্তী সরকারের ধারাবাহিকতা থাকায় চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা নিট বিনিয়োগ করেন বিদেশিরা। তবে পরবর্তী পাঁচ মাস ধারাবাহিকভাবে শেয়ার ক্রয়ের চেয়ে বিক্রি বেশি হওয়ায় চলতি বছর তাদের নিট বিনিয়োগ ১৯ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ঋণাত্মক হয়ে পড়ে।

এর ফলে ২০১৮ সাল থেকে গত ১৯ মাসে ৬১৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেন বিদেশিরা। তবে গত ১৯ মাসে শেয়ার বিক্রি বেশি হলেও এখনো তাদের প্রায় বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে দেশের পুঁজিবাজারে। যদিও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) দৈনিক লেনদেনে তাদের হিস্যা এখনো খুবই কম। বর্তমানে ডিএসইর মোট লেনদেনের মাত্র ১ দশমিক ৭ শতাংশ আসে বিদেশিদের শেয়ার কেনাবেচা থেকে। যেটা ভারতে ৩৫ শতাংশের বেশি।

জানা যায়, দেশের পুঁজিবাজারে ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত নিট বিনিয়োগে ইতিবাচক ধারা ছিল। এ সময় টানা সাত বছরে বিদেশিরা ৮ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা নিট বিনিয়োগ করেছেন। এরপর থেকেই বিদেশিদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ৮ হাজার ৫০ কোটি টাকার নিট বিনিয়োগ রয়েছে তাদের।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত বছরের এপ্রিল থেকে বিদেশিদের বিনিয়োগ প্রত্যাহারের প্রবণতা দেখা যায়। এরপর সাময়িক বিরতির পর চলতি বছরের মার্চ থেকে টানা পাঁচ মাস বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে দেখা যাচ্ছে। যদিও দেশের উৎপাদনমুখী কোম্পানিগুলোর এখন লভ্যাংশের মৌসুম চলছে। আর সরকারও কোম্পানিগুলোর বোনাস লভ্যাংশ নিরুৎসাহিত করতে বাজেটে উদ্যোগ নিয়েছে। গত দেড় বছরের পতন অধিকাংশ শেয়ারও বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশে রয়েছে। তারপরও বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির প্রবণতা ভাবিয়ে তুলছে বাজার সংশ্লিষ্টদের।

সর্বশেষ জুলাই মাসে বিদেশিরা ৭৮৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকার শেয়ার কেনাবেচা করেছেন। এর মধ্যে শেয়ার ক্রয় ছিল ৩০৯ কোটি ৩৬ লাখ টাকার। বিপরীতে বিক্রি করেন ৪৭৪ কোটি ৩ লাখ টাকার শেয়ার। ফলে জুলাই মাসে শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে ১৬৪ কোটি ৬৭ লাখ টাকার বিনিয়োগ সরিয়ে নেন বিদেশিরা। এর আগে মার্চে ১২৩ কোটি ৭০ লাখ, এপ্রিলে ১৫৪ কোটি ৭৮ লাখ, মে মাসে ৬৫ কোটি ১৭ লাখ ও জুন মাসে ১০ কোটি ৫২ লাখ টাকার বিনিয়োগ তুলে নেন বিদেশিরা। আর চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ৪৯৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকার নিট বিনিয়োগ ছিল তাদের।

বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৮ সালে বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাহারের সঙ্গে নির্বাচনের সংযোগ ছাড়াও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের ঝুঁকির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলো ছাড়াও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর অধিকাংশই স্থানীয় মুদ্রার মান কমিয়েছে বা অবমূল্যায়ন করেছে। তবে বাংলাদেশ এখনো বিদেশি মুদ্রার বিপরীতে টাকার শক্তিশালী অবস্থান ধরে রেখেছে।

গত সাত বছরে ভারত ও পাকিস্তান তাদের নিজস্ব মুদ্রার ৫০ শতাংশের বেশি অবমূল্যায়ন করেছে। এ হিসেবে টাকার অবমূল্যায়ন তেমন হয়নি। বিদেশিদের ধারণা, বাংলাদেশও তার মুদ্রার অবমূল্যায়ন করতে বাধ্য হবে। এটি হয়ে গেলেই তারা আরও বেশি বিনিয়োগে এগিয়ে আসবেন বলে বিশেষজ্ঞরা জানান।

জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশিরা বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি প্রত্যাহার করে নেন বিএটি বাংলাদেশের শেয়ার থেকে। ২০১৮ হিসাব বছরের জন্য কোম্পানিটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ বোনাস ঘোষণা করা হয়। আর এই বোনাস ঘোষণায় স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এ কোম্পানির শেয়ারদর প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। আর এ সুযোগে বিদেশিরা এ কোম্পানির উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শেয়ার বিক্রি করে দেন।

এছাড়া গ্লাক্সেস্মিথক্লাইন, বার্জার, লিগ্যাসি ফুটওয়্যার, জিএসপি ফাইন্যান্স, আইএলএফএসএল, সিঙ্গার, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস, ওরিয়ন ফার্মা, ফিনিক্স ফাইন্যান্স, সিটি ব্যাংক, আইডিএলসি, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, এনবিএল, বাংলাদেশ সাবমেরিন কেব্ল কোম্পানি, আইএফআইসি, রানার অটোমোবাইল, ইসলামী ব্যাংক, বেক্সিমকো লিমিটেডসহ উল্লেখযোগ্য কিছু কোম্পানির শেয়ার থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেন বিদেশিরা।

যেসব বিদেশির দেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করছে তাদের বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর বিনিয়োগ কোম্পানি। এছাড়া সিঙ্গাপুর, দুবাইভিত্তিক কিছু বিনিয়োগ কোম্পানিরও বিনিয়োগ রয়েছে। নরডিক দেশগুলোর ব্যবসায়ীদের সমন্বিত বিনিয়োগ কোম্পানি ব্রামার্স অ্যান্ড পার্টনার্স দেশের শেয়ারবাজারে প্রায় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।