এফ জাহান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের একাধিক উদ্যোগের পরেও লেনদেনে গতি ফেরেনি পুঁজিবাজারে। প্রতিনিয়তই বাজারে লেনদেন কমছে। এক হাজার কোটি টাকার গড় লেনদেন তিনশো কোটি টাকায় নেমে এসেছে। চরম আস্থা ও তারল্য সংকটের কারণে এমনটি হচ্ছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, এভাবে বাজার চলতে থাকলে চরম ক্ষতির মুখে পড়বেন বিনিয়োগকারীরা। সম্প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থার ভিত শক্তিশালী করে দীর্ঘমেয়াদে শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করাটাই অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। নতুন বাজেটে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কী কী পদক্ষেপ থাকছে, তার অপেক্ষায় বিনিয়োগকারীরা।

বেসরকারি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব বিজনেসের অধ্যাপক মোহাম্মদ মুসা বলেন, শেয়ারবাজারকে দীর্ঘ মেয়াদে স্থিতিশীলতা দিতে হলে সবার আগে দরকার বিনিয়োগকারীদের আস্থার ভিত শক্তিশালী করা। বাজারের ওপর আস্থা না থাকলে প্রণোদনা দিয়ে বাজারকে খুব বেশি দূর এগিয়ে নেওয়া যাবে না। বর্তমানে ব্যাংক খাতে তারল্যসংকট প্রকট। এ সংকট কাটানোর উদ্যোগ নেওয়া না হলে শেয়ারবাজারেরতারল্য-পরিস্থিতিরও উন্নতি হবে না।

২০১৫ সালের নভেম্বরে ভারতের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়ার (সেবি) তৎকালীন চেয়ারম্যান ইউ কে সিনহা বাংলাদেশ এসে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, যে শেয়ারবাজারে সুশাসনের ঘাটতি থাকে সেই বাজারে দেশি-বিদেশি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীই বিনিয়োগে আগ্রহ দেখান না। আর বাজারে আইনের শাসন থাকলে কিছুসংখ্যক বিনিয়োগকারী ভয়ে থাকেন, কিন্তু তা বাজারের ওপর বেশির ভাগ বিনিয়োগকারীর আস্থা বাড়াতে সহায়তা করে। শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতার জন্য সেবির সাবেক চেয়ারম্যান যেসব কথা বলেছিলেন, তার সবই অনুপস্থিত বাংলাদেশের বাজারে। আইনের কঠোর প্রয়োগের ঘাটতি যেমন এ বাজারে প্রকট, তেমনি প্রকট আস্থার সংকট।

বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারকে স্থিতিশীল ও বিনিয়োগ আকর্ষণের কেন্দ্রে নিতে হলে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কারসাজি করে নামমাত্র জরিমানায় কেউ যেন পার পেয়ে না যান, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সঞ্চয়কে শেয়ারবাজারের মাধ্যমে বিনিয়োগে আনতে হলে মিউচুয়াল ফান্ড খাতে বড় ধরনের সংস্কার জরুরি। বর্তমানে মিউচুয়াল ফান্ডের ওপর বিনিয়োগকারীদের একেবারে আস্থা নেই বলে মনে করেন বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক সভাপতি, ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) বর্তমান সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, সুশাসন, ভালো শেয়ারের অভাব, মিউচুয়াল ফান্ড খাতের চরম দুরবস্থা ও অব্যবস্থাপনাসহ নানাবিধ কারণে শেয়ারবাজার নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। এতে করে সাধারণ মানুষের বিনিয়োগ যেমন এ বাজারে আসছে না, তেমনি ভালো উদ্যোক্তারা সুনাম হারানোর ভয়ে বাজারে আসতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

এদিকে গত এক বছরে যে আইপিওগুলো বাজারে এসেছে সেগুলোর অনেকটাই অভিহিত মূল্যের নিচে অবস্থান করছে। প্লেসমেন্ট ও আইপিও বাণিজ্যের কারণে এমনটি হয়েছে বলে মনে করছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। তাদের মতে প্লেসমেন্টের কারণে হাজার হাজার কোটি টাকা বাজার থেকে চলে গেছে। দুর্বল কোম্পানিকে উচ্চহারে প্রিমিয়াম দিয়ে বাজারে আনার কারণে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ ব্যাপারে ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, তারল্য সংকট ও বাজারে আস্থা না থাকায় লেনদেনে ভাটা পড়েছে। তিনি বলেন, বাজারে এখন আস্থা শূন্যের কোটায় রয়েছে। যতগুলো আইপিও বাজারে এসেছে প্রত্যেকটিতেই বিনিয়োগকারীরা ঠকেছে। তারা ব্যালেন্স শিট এবং আইপিওর ওপর কোনো আস্থা রাখতে পারছে না বলেই বাজারের এমন চিত্র। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে তারল্য বৃদ্ধি ও বাজারে ভালো কোম্পানিকে আনতে হবে বলে মনে করেন মিনহাজ মান্নান ইমন।

অপরদিকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বাজার থেকে দূরে থাকা এবং প্লেসমেন্টের মাধ্যমে বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা চলে যাওয়ার কারণে বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরছে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কোনো ভূমিকা নেই।

মার্চেন্ট ব্যাংক ও আইসিবি বাজারে কোনো ভূমিকা রাখছে না। যদিও বিএসইসি আইপিও বন্ধসহ প্লেসমেন্টের ওপরে রুল জারি করলেও ইতিমধ্যেই প্লেসমেন্টের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা বাজার থেকে চলে গেছে। যার কারণে বিনিয়োগকারীরা নিস্ব হয়ে গেছেন। আস্থা সংকটের পড়ে তারা নতুন করে বিনিয়োগ করতে পারছেন না। যার প্রভাব বাজারে পড়ছে বলে তিনি মনে করেন।

এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, বাজারে তারল্য ও আস্থার সংকট রয়েছে। এ থেকে উত্তোরণে শুধু প্রণোদনা দিলে চলবে না, সরকারের উচিত হবে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোকে বাজারে লিস্টিংয়ে বাধ্য করা। বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, ভালো কোম্পানি এবং দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ করুন, তাহলেই লাভবান হবেন।