এফ জাহান ও এম রহমান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে পর্যবেক্ষণের পর বিনিয়োগ বাড়াতে শুরু করেছে বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানি ও বিনিয়োগকারী। তারা বাজারে শেয়ার বিক্রির চেয়ে বেশি পরিমাণে কিনছে। জুন মাসের পুঁজিবাজারের লেনদেন বিশ্লেষণ করে এমনটি জানা গেছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারের দাম বেশ আকর্ষণীয় হওয়ায় প্রবাসীরা বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। বর্তমান পুঁজিবাজার বিনিয়োগের উপযোগী বলে প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের কাছে দেশের পুঁজিবাজার নতুন করে উপস্থিত হচ্ছে।

পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারের দর হাতের নাগালে রয়েছে, যে কারণে প্রবাসীদের এই মার্কেটের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রতিদিনই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে এবং বাড়ছে শেয়ারবাজারের লেনদেন ও তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারদর। বিনিয়োগযোগ্য প্রেক্ষিতে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারে নতুন করে বিনিয়োগ করছেন। আবার লাভে থাকা শেয়ার বিক্রিও করেছেন।

এদিকে তিন বছর আগের তুলনায় দেশের শেয়ারবাজারে বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগ (এফপিআই) প্রায় তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, প্রকৃত বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যখন নতুন করে বিনিয়োগ করার চেয়ে বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছেন বেশি, তখন প্রবাসী বাংলাদেশিরা বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করছেন।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নিট বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগ ছিল ৪৫ কোটি ৭০ লাখ ডলার। সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৭ কোটি ২০ লাখ ডলারে নেমেছে, যা তিন বছর আগের তুলনায় মাত্র ৩৮ শতাংশ। গত অর্থবছরে বিদেশিরা নিট ৫ কোটি ২০ লাখ ডলারের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করেছেন।

একই সময়ে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ২২ কোটি ৪০ লাখ ডলার নিট বিনিয়োগ করেছেন। যদিও প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিনিয়োগ আগের অর্থবছরের চেয়ে কিছুটা কম। গত অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বাইরে বিদেশিরা যতটা বিনিয়োগ করেছেন শেয়ার বিক্রি করে অর্থ ফেরত নিয়েছেন তার থেকে ৫ কোটি ২০ লাখ ডলার বেশি। কিন্তু প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিট বিনিয়োগ ১৭ কোটি ২০ লাখ ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের দব্যালান্স অব পেমেন্টদ প্রতিবেদনে এ পরিসংখ্যান রয়েছে। প্রকৃত বিদেশি ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকে একত্রে বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগ (এফপিআই) হিসেবে দেখানো হয়। শুধু গত অর্থবছরেরই নয়, এর আগের অর্থবছরেও একই চিত্র ছিল। ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগ ছিল ৪৫ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

২০১৭-১৮ সালে তা ৩৪ কোটি ৯০ লাখ ডলারে নেমে আসে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ৪৫ কোটি ৭০ লাখ ডলারের মধ্যে প্রকৃত বিদেশিদের নিট বিনিয়োগ ছিল ২৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিট বিনিয়োগ ছিল ১৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার। পরের অর্থবছরে সাড়ে ৩৪ কোটি ৯০ লাখ ডলারের পোর্টফোলিও বিনিয়োগে প্রকৃত বিদেশিদের নিট বিনিয়োগ ছিল ৭ কোটি ডলার এবং প্রবাসীদের ছিল ২৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার। অর্থাৎ ওই বছর বিদেশিদের নিট বিনিয়োগ ৬৯ শতাংশ কমে যায়। প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিট বিনিয়োগ বেড়েছিল প্রায় ৫৬ শতাংশ।

বিদেশিরা যখন বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছে তখন প্রবাসী বাংলাদেশিরা (এনআরবি) কোনো বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করছেন- এমন প্রশ্নে সেন্টার ফর নন-রেসিডেন্ট বাংলাদেশির চেয়ারপারসন শেকিল চৌধুরী বলেন, গত কয়েক বছরে বিভিন্ন দেশে গিয়ে প্রবাসীদের দেশে সরাসরি বা শেয়ারবাজারের মাধ্যমে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। ফলে প্রবাসীদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাড়তে পারে বলে মনে করেন তিনি।

বিদেশিরা যখন শেয়ারবাজার থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করছেন, তখন প্রবাসী বাংলাদেশিদের আগ্রহকে কীভাবে দেখছেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে শেকিল চৌধুরী বলেন, নানা সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য জেনেও প্রবাসীরা স্রেফ দেশকে ভালোবেসে বিনিয়োগ করেন। তবে বিদেশিরা যেখানে মুনাফাসহ পুঁজি ফেরতের নিশ্চয়তা পাবেন, সেখানেই বিনিয়োগ করেন। সা¤প্রতিক সময়ে দেশের আর্থিক খাতের দুরবস্থা বিদেশিদের বিনিয়োগ কমে যাওয়ার বড় কারণ বলে মনে করেন সেন্টার ফর এনআরবির এই সংগঠক। তিনি বলেন, এখানে ভালো শেয়ারের জোগান নেই।

এখন যেসব কোম্পানির আইপিও আসছে সেগুলো তাদের আর্থিক অবস্থার জোরে নয় বরং নেপথ্যের প্রভাবশালীদের ক্ষমতার ওপর ভর করে আসছে। এমন বাজার থেকে বিদেশিদের বিনিয়োগ কমে যাওয়া স্বাভাবিক। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে প্রবাসীদের এ বিনিয়োগের ধারা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে কি-না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি।

বাজারসংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, কিছু ব্যক্তি দেশের টাকার বাইরে পাচার করে বা পাচার করা অর্থের কিছু অংশ বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগের নামে দেশে আনেন। আবার শেয়ার কারসাজির উদ্দেশ্যেও প্রবাসীদের নাম ব্যবহার করে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের কেউ কেউ শেয়ার ব্যবসা করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শীর্ষ এক মার্চেন্ট ব্যাংক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, বিষয়টি দেশের শেয়ারবাজারে অনেকটা দওপেন সিক্রেটদ বিষয়। অনেকে এমন বিনিয়োগকে দফরেন কোডে লোকাল বাইদ বলে অভিহিত করেন। স¤প্রতি একটি বীমা কোম্পানিতে এমন বিনিয়োগের উদাহরণ দিয়ে শীর্ষ এক ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তা সমকালকে জানান, বীমা কোম্পানিটির এক পর্যদ সদস্যের বিদেশে থাকা আত্মীয়ের মাধ্যমে ওই কোম্পানির শেয়ার কিনেছেন তিনি। উদ্দেশ্য এর শেয়ারদর বৃদ্ধি।

সূত্র আরও জানায়, বর্তমানে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ৩১৯টি হলেও প্রকৃত বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ২৫টির বেশি কোম্পানিতে বিনিয়োগ নেই। কিন্তু কোম্পানিগুলোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, অন্তত ১৩৬ কোম্পানিতে বিদেশিদের বিনিয়োগ রয়েছে। অর্থাৎ বিদেশিদের তুলনায় প্রবাসীদের বিনিয়োগ বেশি সংখ্যক কোম্পানিতে।