আমিনুল ইসলাম ও মোবারক হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা:  বীমা খাতে ব্যয়ের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আসছে না। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গ্রাহকের অর্থ ব্যয় করছে কোম্পানিগুলো। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে লাখ লাখ বীমা গ্রহীতা ও বিনিয়োগকারীরা। এছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে টানা দুই বছর ৯ মাস বীমা কোম্পানির বিশেষ নিরীক্ষা (অডিট) বন্ধ রয়েছে।

একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী মন্ত্রণালয়কে প্রভাবিত করায় এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। তবে আইডিআরএ বলছে, নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার ব্যাপারে চেষ্টা চলছে। এছাড়া গ্রাহকের পলিসির টাকা বেপরোয়া ব্যয়সহ বীমা কোম্পানিগুলোর নানা অনিয়ম রোধে কঠোর অবস্থানে এখাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইন্স্যুরেন্স ডেলেপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথোারিটি (আইডিআরএ)।

জানা গেছে, কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গ্রাহকের টাকা বেপরোয়াভাবে ব্যয় করছে বীমা কোম্পানিগুলো। দেশের ৩২ জীবন বীমা কোম্পানির আর্থিক বিষয়সহ যাবতীয় কার্যক্রমের বিশেষ নিরীক্ষা শুরু করেছে তারা। এরমধ্যে সরকারি কোম্পানি জীবন বীমা কর্পোরেশন, যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি মেট লাইফ ও ভারতীয় কোম্পানি এলআইসিও রয়েছে।

ইতিমধ্যে সবগুলো কোম্পানিতে অডিট ফার্ম (নিরীক্ষক) নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তারা ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ এই বছরের কোম্পানি সমস্ত আর্থিক কার্যক্রম নিরীক্ষা করবে। আগামী তিনমাসের মধ্যে তারা প্রতিবেদন জমা দেবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনিয়ম বিষয়টি এবার চিহ্নিত হবে।

উল্লেখ্য এর আগে ২০১৮ সালে ৮টি কোম্পানিতে বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগ দেয় আইডিআরএ। কিন্তু তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের হস্তক্ষেপে তা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন আর বিশেষ নিরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

এ বিষয় জানতে চাইলে আইডিআরএর সদস্য ড. এম মোশাররফ হোসেন এফসিএ বলেন, আমাদের মূলকাজ হল গ্রাহকের স্বার্থ সংরক্ষণ করে এ শিল্পের বিকাশ ঘটানো। এজন্য বীমাখাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে চাই। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন থেকে এখানে বিশেষ নিরীক্ষা বন্ধ ছিল। এখন এটি শুরু করা হয়েছে। তারমতে, নিরীক্ষার ফলে কোম্পানিগুলোর ভয়ের কিছু নেই। কারণ স্বচ্ছতা এলে বীমাখাতের প্রতি গ্রাহকের আস্থা বাড়বে। দীর্ঘমেয়াদে এতে কোম্পানিগুলোই লাভবান হবে।

আইডিআরএ সূত্র জানায়, বীমা আইন ২০১০ সালের ৬২ ধারায় বীমা কোম্পানিগুলোর ব্যয় সীমা দেয়া আছে। কিন্তু অধিকাংশ কোম্পানি এই সীমা মানছে না। গ্রাহককে ভবিষ্যতে টাকা ফেরত দিতে হবে, এ চিন্তা না করেই সীমাহীনভাবে টাকা ব্যয় করছে। এরফলে পলিসি হোল্ডার এবং এসব কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

সূত্র জানায়, কোম্পানিগুলো তাদের পলিসিতে বড় ধরনের জালিয়াতি করছে। কোম্পানিতে যে পরিমাণ পলিসি ইস্যু হয়, কাগজপত্রে দেখানো তার অর্ধেকেরও কম। এক্ষেত্রে কোম্পানির নামে অনেকগুলো ব্যাংক একাউন্ট খোলা হয়। কিন্তু বাস্তবে একাউন্টের সংখ্যা কম দেখানো হয়। যে সব একাউন্ট আইডিআরএ’সহ নিয়ন্ত্রকসংস্থাগুলোর কাছে যাবে সেগুলোতে রাখা অর্থই কেবল কোম্পানির আয়ের হিসাবে দেখানো হয়। বাকী বেশ কিছু পলিসির তথ্য গোপন রাখা হয়। এগুলো শুধু কোম্পানির ভেতরের লোকজন জানে।

এজন্য ব্যাংকে আলাদা একাউন্ট সংরক্ষণ করা হয়। আর কমিশন বাণিজ্যসহ অধিকাংশ অতিরিক্ত ব্যয় এসব একাউন্ট থেকে পরিশোধ করা হয়। অন্যদিকে পলিসির মেয়াদ শেষে গ্রাহকের টাকা পরিশোধের সময় নানা টালাবাহানা শুরু করে। তবে অডিটে এগুলো ধরা পড়বে বলে মনে করছে আইডিআরএ। অন্যদিকে কোম্পানির একাউন্ট পরিচালনার ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতা আনা হচ্ছে। কোম্পানিগুলোর জন্য মাত্র একটি একাউন্ট পরিচালনা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে শিগগিরই আইডিআরএ’র পক্ষ থেকে নির্দেশনা যাবে।

এ বিষয় জানতে চাইলে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশের বীমাখাতের পরিস্থিতি খুব একটা বেশি ভাল নয়। সামগ্রিকভাবে এখাতের প্রতি মানুষের আস্থা সংকট রয়েছে। এ সংকট কাটাতে হলে এখানে স্বচ্ছতা ফিরাতে হবে। সে হিসাবে অবশ্যই এটি ভাল উদ্যোগ। তিনি বীমা কোম্পানিগুলোর একে ইতিবাচক হিসাবে বিবেচনা করা উচিত।

আইডিআরের শর্ত অনুসারে অডিট ফার্মগুলো নিরীক্ষা করবে এরমধ্যে রয়েছে: কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয়, ব্যবসায়িক পরিস্থিতি, আর্থিক অবস্থা, গ্রাহককে দেয়া কমিশন, গ্রাহককে পরিশোধ করা দাবি, সম্পদের পরিমাণ, বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ বিতরণ এবং প্রশাসনিক ব্যয়সহ তিন বছরের জাতীয় হিসাব আইন অনুসারে হয়েছে কীনা তা নিরীক্ষা করতে হবে। আবার যে সব অডিট ফার্মের রিপোর্ট বেশি স্বচ্ছ হবে, পরবর্তীতে তাদেরকে কাজ দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।

এ বিষয় জানতে চাইলে বীমা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, এ শিল্পের স্বার্থে যে কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। কারণ বিশেষ অডিট হলে এখাতের সবকিছু পরিস্কার হয়ে যাবে। এদিকে গত বছরের শেষের দিকে দেশের ১৬টি বীমা কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যয়ের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে আইডিআরএ চিঠি দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন। কোম্পানিগুলো আইন লংঘন করে ১ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছিল।

দুদক সূত্র জানায়, বিদ্যমান আইন অনুসারে বীমা কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না দুদক। এক্ষেত্রে তারা শুধু তদন্ত করতে পারে। তাই দুনীতি প্রতিরোধে বিদ্যমান বীমা আইনের সংশোধন চায় দুদক। এ লক্ষ্যে ইতিমধ্যে অর্থমন্ত্রণালয় একটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। তবে বিষয়টি আলোচনাধীন রয়েছে। এ কারণে বীমা কোম্পানির আর্থিক রিপোর্ট তদন্ত করে অনিয়ম পাওয়ার পর ব্যবস্থা নিতে আইডিআরের কাছে পাঠানো হয়েছে।
দুদকের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ১৬টি বীমা কোম্পানি আইনে উলে¬খিত সীমার চেয়ে অতিরিক্ত ব্যয় করেছে।

কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে- পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্স ২৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, সানলাইফ ৮৪ কোটি ১৩ লাখ, পদ্মা লাইফ ১৬৬ কোটি ৮৩ লাখ টাকা, প্রগতি লাইফ ১৪৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা, সানফ্লাওয়ার লাইফ ৮৬ কোটি ১৮ লাখ, মেঘনা লাইফ ৮৩ কোটি ৯৪ লাখ, ন্যাশনাল লাইফ ২১ কোটি ৩৭ লাখ, গোল্ডেন লাইফ ১৫৬ কোটি ২৫ লাখ, বায়রা লাইফ ৩৮ কোটি ৬৫ লাখ, সন্ধ্যানী লাইফ ১৫৫ কোটি ৫৯ লাখ, প্রগ্রেসিভ লাইফ ৩৯ কোটি ৪৪ লাখ, হোমল্যান্ড লাইফ ৪৬ কোটি ৯৫ লাখ, প্রাইম ইসলামী লাইফ ৭১ কোটি ৭৯ লাখ, ফারইস্ট লাইফ ২০০ কোটি ৫১ লাখ, রূপালী লাইফ ৪৪ কোটি ৪০ লাখ এবং ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স ৫৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে।

আইডিআরএ সূত্র জানায় দেশের ৭৮টি বীমা কোম্পানির মধ্যে জীবন বীমা ৩২টি এবং সাধারণ বীমা ৪৬টি। দুইখাত মিলিয়ে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৪৭টি। দেশের অর্থনীতির আকার অনুসারে কোম্পানির অনেক বেশি। কিন্তু এরপর দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বীমাখাতের অবদান ১ শতাংশেরও কম। এর সবচেয়ে বড় কারণ হল- কোম্পানিগুলোর সীমাহীন প্রতারণার কারণে বিশাল এইখাতের প্রতি মানুষের আস্থা নেই। কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই রাজনৈতিক বিবেচনায় বেশ কিছু বীমা কোম্পানির অনুমোদন দেয়া হয়েছে।

এসব কোম্পানিগুলোর পেছনে বড় মাপের ধরনের রাজনৈতিক নেতাদের আর্শীবাদ রয়েছে। ফলে এরা কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করছে না। ২০১০ সালে নতুন বীমা আইন হওয়ার পর পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও এখনও ব্যাপক অনিয়ম রয়েছে। তবে এর পাশাপাশি আশার দিকও কম নয়। এক বছরে এখাতের নিয়ন্ত্রকসংস্থা আইডিআরে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। প্রতিদিনই দাবি পরিশোধ করছে সংস্থাটি।

দাবি করলে লাইসেন্স বাতিল করা হবে, এ ধরনের কঠোর বার্তা দেয়া হয়েছে কোম্পানিগুলোকে। আইডিআরএ’র জনবল বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রায় ৬৩২ কোটি টাকার অটোমেশন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে এর অর্থের একটি অংশ ছাড় হয়েছে।