বিদেশিদের ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর বাজার ওঠা-নামা করে, এটা বাজারের অত্যন্ত দুর্বল দিক। এর মূল কারণ হলো আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, মিউচুয়াল ফান্ড কারও কোনো ভূমিকা নেই। অপারেটর গ্রামীণফোন ও রবির সাথে সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির দ্বন্ধে টেলিকম সেক্টরে চরম অস্থিরতা। বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির চাপ সামাল দেয়ার মতো কোনো প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী আমাদের মার্কেটে নেই। যখন বিদেশিরা শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়ায় তখন ক্রেতা থাকে না এবং বাজারে পতন হয় বলে আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি এফ জাহান ও মোবারক হোসেন একান্ত সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে স্টক এক্সচেঞ্জটির পরিচালক রকিবুর রহমানের।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, পুঁজিবাজার রাতারাতি বড়লোক হওয়ার জায়গা নয়। বড়লোক হওয়ার হুযুগে যে বিনিয়োগকারী শেয়ার কিনেছেন তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বাজার ধসের জন্য সংশ্লিষ্ট কোম্পানি, ব্রোকারেজ হাউজ এবং ব্যাংক দায়ী নয়। বুঝে-শুনে শেয়ার কিনলে এমন পরিণতি হতো না। তাই বিনিয়োগকারীদের অধিক সচেতনার সঙ্গে শেয়ার কিনতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন।
রকিবুর রহমান আরো বলেন, দরবৃদ্ধি বা দরপতনের মতো সাময়িক বিষয় নিয়ে আমার মূল্যায়ন নেই, এ নিয়ে চিন্তিতও নই।

আমার চিন্তার বিষয় লেনদেন বা বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ নিয়ে, যা খুবই কম। বাজারে স্বাভাবিক ও যথেষ্ট অংশগ্রহণ থাকলে কখনও কোনো অস্থিরতা তৈরি হলে দ্রুত তা স্বাভাবিক হয়ে যায়। আমাদের সমস্যা হলো এ বাজারের সবাই সূচকে নজর রেখে বিনিয়োগ করেন। ২/৪টি শেয়ারের কারণে সূচক কমলে বাকি ১০০ কোম্পানির শেয়ারহোল্ডাররা ভয়ে শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করেন। এটা ঠিক নয়। আরও দুঃখের বিষয় হলো, শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজও সূচকের ওঠানামা মনিটর করা নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, এখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থা জড়িয়ে যায় বা জড়ানো হয়।

বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে লেনদেন কম হওয়ার কারন হলো: বর্তমান পুঁজিবাজারে কোনো প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ নেই। যথেষ্ট মিউচুয়াল ফান্ডও নেই। যা আছে, সেগুলোর পরিচালনাকারী সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানি দায়িত্বশীল নয়। এখানে আইডিএলসির মতো দায়িত্বশীল প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী নেই। শত শত প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করলেও তারা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মতো আচরণ করে। যে বাজারের বিনিয়োগের ৮০ শতাংশ স্বল্পমেয়াদী, সেখানে স্থিতিশীলতা আশা করা দুরূহ। এ ছাড়া আর্থিক খাতের দুরবস্থার কারণে তারল্য প্রবাহে সংকট আছে।

রকিবুর রহমান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, শেয়ারবাজার প্রকৃত অর্থেই শেয়ারবাজার হয়ে ওঠেনি। গুটিকয় কোম্পানি ছাড়া এখানে ভালো কোম্পানির শেয়ার নেই। ভালো শেয়ার আনার প্রচেষ্টাও নেই, বরং মন্দ কোম্পানির শেয়ার আনতে প্রভাবশালীরা তৎপর। তা ছাড়া এ বাজারে ভালো বিনিয়োগকারী নেই, সবাই রাতারাতি বড়লোক হতে চায়। তারা বিনিয়োগের নামে যা করেন, তা জুয়া খেলা ছাড়া কিছু নয়।

এখানে আইনের প্রয়োগ নেই। সুশাসনের অভাবও প্রকট। প্রভাবশালীদের জন্য আইন এক রকম, সাধারণের জন্য অন্য রকম। বাজারের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন কর্মপন্থা নির্ধারণসহ চলতি সমস্যা সমাধানে যে ধরনের গবেষণা থাকা দরকার, সেটিও অনুপস্থিত। নানা অনিয়মের শাস্তি না হওয়ায় বাজারের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাও নেই।

১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত শেয়ারবাজারের বয়স এখন ৬৫ বছর। এ দীর্ঘ সময়েও প্রকৃত অর্থে বাজার হয়ে না ওঠার ব্যর্থতা নানা কারন রয়েছে। এ ব্যর্থতা সবার, সব স্টেকহোল্ডারের। দেখেন, সব দেশের শেয়ারবাজারের চরিত্র একই রকম।

এর সংকট এবং সমাধানের পথও প্রায় একই রকম। আমাদের বাজারের আজকের যে সমস্যা, তা অন্য সব দেশের; এমনকি উন্নত বিশ্বের শেয়ারবাজারগুলোও একই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আজকের পরিণত অবস্থায় এসেছে। স্রেফ তাদের পথ অনুসরণ করলেই আমাদের সমস্যার সমাধান মিলবে। এ জন্য নতুন করে গবেষণার প্রয়োজন নেই। দরকার আন্তরিকতার, যা একেবারে অনুপস্থিত।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কি যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে কিনা এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি মনে করি, ব্যর্থতা সবার। শেয়ারবাজারের যে কোনো সংকট সমাধানে অভিভাবক হিসেবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির প্রাথমিক দায়িত্ব বেশি। তবে এককভাবে সংস্থার পক্ষে পুরোটা করা সম্ভব নয়। লক্ষ্য করলে দেখবেন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীন, ভারতসহ সব দেশে যখনই শেয়ারবাজার সংকটে পড়ে তখন সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সব পর্যায় থেকে নানা সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া হয়। আমাদের এখানে সমন্বিত উদ্যোগের ঘাটতি আছে।

সা¤প্রতিক দরপতন বন্ধে সরকার কিন্তু বাজেটের মাধ্যমে বাস্তবসম্মত বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। অযথা বোনাস শেয়ার দেওয়া, মুনাফার বড় অংশ রেখে দেওয়া নিরুৎসাহিত করতে বাজেটের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিয়েছে। এমন পদক্ষেপের পরও কোনো ফল পাইনি। এর কারণ হয়তো সমস্যা অন্যখানে। হয়তো আমরা সমস্যা চিহ্নিত করতে সরকারকে করণীয় বিষয়ে সঠিক পরামর্শ দিতে পারছি না।

লক্ষণীয় বিষয়, বিএসইসিও বেশ কিছু ভালো আইনি সংস্কার এনেছে। যেমন আইপিও আইন সংশোধন করেছে। মিউচুয়াল ফান্ডের নগদ লভ্যাংশের পরিবর্তে আরআইইউর নামে বোনাস দেওয়ার পথ বন্ধ করেছে। সবগুলোই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এখন প্রধান সমস্যা বাজারে তারল্য নেই। যেসব কোম্পানি তালিকাভুক্ত হচ্ছে, সেগুলোর মান নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।

এসব কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্বাসযোগ্য নয়। বিষয়টি যথাযথভাবে দেখছে না কেউ। কিছু চক্র হুটহাট শেয়ারদর বাড়িয়ে মুনাফাও তুলে নিচ্ছে। অথচ জড়িতদের তেমন শাস্তি হয় না। মালিকরা গোপনে শেয়ার বিক্রি করছেন, কাউকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয় না। এসব কারণে মানুষ আস্থা হারিয়েছে, যা পুনরুদ্ধারে পদক্ষেপও নেই।