দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ উঠেছে। তাদের এমন অনিয়মে প্রধানমন্ত্রী নিজেই তাদের উপর উপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন। সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সাথে কথা বলে ও গোয়েন্দা সূত্রে পাওয়া তথ্য মতে ৫ কারণে প্রধানমন্ত্রী তাদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী সম্পর্কে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসন্তোষের মনোভাব বদলায়নি।

‘কমিটি ভেঙে দাও’ নীতিতে তিনি অটল রয়েছেন। তিনি নিজেই বিকল্প নেতৃত্ব খুঁজছেন। ছাত্রলীগ নিয়ে এ মুহূর্তে তিনি কারও সঙ্গে কোনো কথা বলছেন না। নেতারাও এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছেন।

এ মুহূর্তে দলের ভিতরে-বাইরে আলোচনায় বিকল্প নেতৃত্বে আসছেন কারা? নাকি সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠন করা হবে? ছাত্রলীগের দুই নেতার কর্মকান্ডের দায়ভার কেন পুরো কমিটিকে নিতে হবে? সবকিছু নিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর একটা পরিস্থিতি। সম্মেলনের প্রায় তিন মাস পর গত বছরের ৩১ জুলাই রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রাব্বানীকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়।

কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে গত শনিবার রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার ও সংসদীয় বোর্ডের যৌথসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, আমি ছাত্রলীগের এমন নেতা চাই না, যাদের বিরুদ্ধে মাদকের অভিযোগ পর্যন্ত ওঠে। এরপরই এই দুই ছাত্রনেতার গণভবনে প্রবেশের স্থায়ী পাস বাতিল করা হয়। তারা কয়েক দফা গণভবনে প্রবেশের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। প্রধানমন্ত্রীর এমন কঠোর মনোভাবের পরও বদলাননি ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।

সভাপতি শোভনের বিরুদ্ধে এক সাংবাদিককে গাড়িতে তুলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। গত মঙ্গলবার মধুর ক্যান্টিনের সামনে শোভনের অনুসারী ছাত্রলীগের দুই সহ-সভাপতি তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী জহির ও শাহরিয়ার কবির বিদ্যুৎ মারামারি করেন। এতে দুজনই আহত হন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত দৈনিক ইনকিলাবের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার নূর হোসেন ইমন মুঠোফোনে ঘটনার ভিডিও ধারণ করেন। এটি দেখে ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি নাহিয়ান খান জয় ওই সাংবাদিকের মুঠোফোন কেড়ে নিয়ে জোর করে ভিডিও মুছে দেন।

পরে শোভন তাকে জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যান। বিষয়টি সাংবাদিক সমিতি নেতৃবৃন্দ অবহিত হলে তাকে নামিয়ে দেওয়া হয়। কমিটি ভেঙে দেওয়ার আলোচনার মধ্যেই ডাকসু সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী ডাকসুর নিজ অফিস কক্ষে এয়ার কন্ডিশন (এসি) লাগানো নিয়ে নতুন বিতর্কে জড়ান। এদিকে মাত্র সাত দিনেই পাল্টে গেছে চিত্র। তেমন হোন্ডা ‘প্রটোকল’ নেই ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর গাড়িবহরে।

বাসার নিচে দেখা মিলছে না শত শত নেতা-কর্মী আর হোন্ডা বাহিনী। ছাত্রলীগকে ‘ভাইয়া লীগ ও সেলফিবাজি লীগ’-এ পরিণত করা শোভন-রাব্বানীকে এখন সবাই এড়িয়ে চলছেন। সংগঠনের দায়িত্ব পাওয়ার পর ‘মুই কি হনু রে’ মনোভাব নিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যেসব নেতাকে ‘উপেক্ষা’ করে চলতেন, এবার তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন শোভন-রাব্বানী। অথচ এসব নেতার অনেকের ফোন রিসিভ করতেন না তারা।

যেসব অভিযোগ শোভন-রাব্বানীর বিরুদ্ধে : ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণার পর থেকেই অভিযোগ ছিল মাদক সেবন, দুপুর পর্যন্ত ঘুমানো, মধুর ক্যান্টিনে না যাওয়া, সংগঠনের কর্মসূচিতে প্রধান অতিথিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখা ইত্যাদি। তিন মাসের মাথায় সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে শিক্ষা ভবন, খাদ্য ভবন, গণপূর্ত, বিদ্যুৎ ভবনসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর উন্নয়নে টেন্ডারবাজি।

৮০ লাখ টাকার বিনিময়ে ঢাকার পার্শ্ববর্তী একটি উপজেলায় সাধারণ সম্পাদক পদ বিক্রি, জেলা কমিটি উপেক্ষা করে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে কেন্দ্র থেকে উপজেলা কমিটি দেওয়ার অভিযোগ আছে। জানা গেছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কিছু দিন আগে অসুস্থ হয়ে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেখানে দেখা করতে গিয়ে রাব্বানী হলগুলোর উন্নয়ন কাজে টেন্ডার থেকে দুই কোটি টাকা দাবি করেন।

হুমকির সুরে রাব্বানী বলেন, ‘আপনাকে যে ভিসি বানিয়েছেন, আমাকেও তিনি নেতা বানিয়েছেন। আমি যা বলছি, তা দিতে হবে।’ এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ দেওয়া হয়। তবে রাব্বানী ১ কোটি টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাস ভবন স্থানান্তরে টেন্ডারের ভাগ পেতে তুচ্ছ কারণে কমিটি বিলুপ্ত করেন গোলাম রাব্বানী ও শোভন। রাব্বানীর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ, তিনি সাভারে জমি কেনাবেচা চক্রের সঙ্গে জড়িয়েছেন।

এ ছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সম্মেলনে প্রধান অতিথি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সকাল ১১টা থেকে বসিয়ে রেখে শোভন-রাব্বানী আসেন বিকাল ৩টায়। ওই অনুষ্ঠানে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে সুলতান মোহাম্মদ ওয়াসী নামের এক ছাত্রলীগ নেতা মারা যান। শোভন-রাব্বানীর খামখেয়ালিপনায় ওই কর্মীর মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে।

ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদও। তাকে আড়াই ঘণ্টা বসিয়ে রাখার পর আসেন শোভন-রাব্বানী। এ ছাড়া শোভন-রাব্বানীর বিরুদ্ধে মাদক সেবনের অভিযোগ রয়েছে। তারা ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজা সেবন করেন। গুলিস্তানে ছাত্রলীগের কার্যালয়ে ফেনসিডিলের অসংখ্য বোতল দেখে আওয়ামী লীগের জনৈক নেতা ছবি তুলে তা প্রধানমন্ত্রীকে দেখান। পরে নিজের রুমে ছাত্রলীগের সভাপতি শোভন ফেনসিডিল খাচ্ছেন এমন ছবিও পাঠানো হয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে।

দলীয় সূত্র জানায়, নেতা হতে হলে কমিটি কেনাবেচায় আগে কথা বলতে হয় সহ-সভাপতি শাহরিয়ার কবির বিদ্যুৎ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ চৌধুরী ও ড্রাইভার ফারুকের সঙ্গে। তারা শোভনের নিজস্ব লোক। শোভনের চাচাতো ভাই দাবিদার রাফির সঙ্গে ৩০ লাখ টাকার বিনিময়ে সাতক্ষীরা জেলা কমিটি ভেঙে দেওয়ার একটি অডিও গতকাল গণমাধ্যমে ফাঁস হয়েছে।

শোভনের ছোট ভাই রাকিনুল হক চৌধুরী ছোটন সংগঠনের আন্তর্জাতিক সম্পাদক। তার নেতৃত্বে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় আলাদা বলয় তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে মধুর ক্যান্টিনে এক নারী নেত্রীকে লাঞ্ছিত করেন গোলাম রাব্বানী।

৫ ইস্যুতে শোভন-রাব্বানীর উপর ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী: ১.বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নির্ধারিত সময়ে না থাকা। গত ২০ জুলাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগেরই একটি অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যান নির্ধারিত সময় সকাল ১১টায়৷ ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যান বিকেল তিনটায়।

২.জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ইডেন মহিলা কলেজের সম্মেলন হওয়ার পর দেড় মাস চলে গেলেও কমিটি গঠন না করা।

৩. নিয়ম বহির্ভূতভাবে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি করা।

৪. ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয় সম্মেলনের এক বছর পর ১৩ মে৷ তবে সম্মেলনের আড়াই মাস পর রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রাব্বানীকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করা হয়। কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের পরই তা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক দেখা দেয়। পরে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে কমিটি থেকে বিতর্কিত ১৯ জনকে বাদ দেয়ার ঘোষণা দিয়েও বাস্তবে বাদ না দেয়া।

৫. আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ।

অভিযোগ আছে কেন্দ্রীয় কমিটিতে অর্থের বিনিময়ে পদ দেয়া হয়। জেলা কমিটিকে না জানিয়ে সরাসরি অর্থের বিনিময়ে সাতটি উপজেলা কমিটি গঠন৷ নারায়ণগঞ্জ এবং কক্সবাজারসহ বিভিন্ন জেলা কমিটিতে অর্থের বিনিময়ে নিজস্ব লোক ঢুকানো। আর্থিক সমঝোতা না হওয়ায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ও ইডেন কলেজের কমিটি গঠনে দেরি করা।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে দেখা যায় কেন্দ্রীয় কমিটিতে যাদের ঠাঁই দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে ৩৭ জনের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ আছে। এই অভিযোগগুলো হলো বিবাহিত, বহু বিবাহ, অছাত্র, মাদক ব্যবসায়ী, মাদকাসক্ত, জামায়াত ও শিবিরের সাথে যুক্ত, শিক্ষকের ওপর হামলাকারী প্রভৃতি৷ এই সব অভিযোগে অভিযুক্তদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঠাঁই দেয়ার পিছনে আর্থিক লেনদেন আছে বলে ধারণা করা হয়।