বিদেশী বিনিয়োগে করোনায় বড় ধাক্কা
দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: যেমন আশঙ্কা করা হচ্ছিল, তাই ঘটেছে; করোনাভাইরাস মহামারীতে বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগে (এফডিআই) ধস নেমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বিদায়ী অর্থবছরের ১১ মাসের (জুলাই-মে) বিদেশী বিনিয়োগের যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে এই করুণ চিত্রই দেখা গেছে। গত বছর বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ আগের বছরের অর্ধেকে নেমে আসার পর এবার তাতে আরো অধোগতির আশঙ্কা করা হচ্ছিল। গত ১৬ জুন জাতিসঙ্ঘের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংস্থা আঙ্কটাড বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদনে দেখিয়েছিল, গত বছর (ক্যালেন্ডার বছর) বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে আগের বছরের অর্ধেকের কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গত ১১ মাসে বিভিন্ন খাতে সবমিলিয়ে ৩৭২ কোটি ৮০ লাখ ডলার এফডিআই এসেছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ শতাংশ কম। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে ৪৩২ কোটি ৫০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। ২০১৯-২০ অর্থবছর ফুরোলেও এক মাসের হিসাব এখনো আসেনি। তবে মহামারী এখনো চলতে থাকায় তা এলেও চিত্র বদলাবে না বলেই মনে করছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।
পুঁজিবাজারে ৩০ ব্যাংকের মধ্যে ১৯ ব্যাংকের মুনাফায় উল্লম্ফন
তারা বলছেন, বিদেশী বিনিয়োগ না বাড়লে দেশী বিনিয়োগও বাড়বে না, ফলে মহামারীতে ওলটপালট অর্থনীতি আরো নাজুক হয়ে পড়বে। অবকাঠামো ঘাটতিসহ নানা কারণে দেশে প্রত্যাশিত মাত্রায় সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ আসছে না। কিন্তু ২০১৮-১৯ অর্থবছরে হঠাৎ করেই বিদেশী বিনিয়োগে উল্লম্ফন দেখা যায়। ওই অর্থবছরে ৪৫০ কোটি ১০ লাখ (৪.৫ বিলিয়ন) ডলারের রেকর্ড এফডিআই পায় বাংলাদেশ। তবে সে বছর আজিক গ্রুপের ব্যবসা কেনার সুবাদে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করেছিল জাপানের কোম্পানি জাপান টোব্যাকো। তার প্রভাবে বেড়ে গিয়েছিল এফডিআই।
২০১৯-২০ অর্থবছরে সেই ইতিবাচক ধারা আর থাকেনি। এই অর্থবছরে লেগেছে মহামারীর ধাক্কা। বিদেশী বিনিয়োগে অশনি সঙ্কেত : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ৩৬৮ কোটি ডলারের এফডিআই এসেছিল, পরের মে মাসে আসে মাত্র চার কোটি ৮০ লাখ ডলার। এ হিসাবে ১১ মাসে এফডিআই কমেছে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। মে পর্যন্ত ১১ মাসে নিট এফডিআই এসেছে ১৯৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার। আগের বছরে একই সময়ে এসেছিল ২৪২ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এ হিসাবে ১১ মাসে নিট এফডিআই কমেছে ১৯ শতাংশ।
বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে মোট যে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ আসে, তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ দেশে নিয়ে যাওয়ার পর যেটা অবশিষ্ট থাকে, সেটাকেই নিট এফডিআই বলা হয়ে থাকে। এই ১১ মাসে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে যে বিদেশী বিনিয়োগ (পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট) এসেছে, চলে গেছে তার চেয়ে বেশি।
২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে পুঁজিবাজারে ১৬ কোটি ২০ লাখ ডলারের নিট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল। ২০১৯-২০ অর্থবছরের এই ১১ মাসে যে বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে তার থেকে ৭০ লাখ ডলার বেশি চলে গেছে।
বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের চেম্বার অ্যামচেমের সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে এফডিআইয়ের প্রধান সমস্যা হচ্ছে ‘ব্র্যান্ডিং’। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সামনে আমরা এখনো আমাদের ব্র্যান্ডিং যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারিনি। এ ছাড়া আমাদের বন্দরের সমস্যা আছে। এত দিনেও আমরা বন্দরের অটোমেশন করতে পারিনি। এটা খুবই দুঃখজনক। এ ছাড়া গত বছরের প্রায় পুরোটা সময়জুড়ে গ্রামীণফোনের (জিপি) নিরীক্ষা আপত্তির টাকা নিয়ে বিটিআরসির সাথে সমস্যা বাংলাদেশে এফডিআই আসার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে বলে আমি মনে করি।
এরশাদ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ অর্থনীতির আকারের বিবেচনায় অনেক কম। এর মূল কারণ অবকাঠামোর ঘাটতি এবং অর্থনৈতিক কূটনীতির অভাব। এ বিষয়ে অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশী বিনিয়োগ না বাড়লে বিদেশী বিনিয়োগও বাড়বে না।
কয়েক বছর ধরে আমাদের বিনিয়োগ একই জায়গায় আটকে আছে; জিডিপির ৩১ থেকে ৩৩ শতাংশের মধ্যে। এই কয়েক বছরে সরকারি বিনিয়োগ কিছুটা বাড়লেও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়েনি। আহসান মনসুর বলেন, এখন কোভিড-১৯ এর কারণে সবকিছুই ওলটপালট। এফডিআইও কমবেÑ এটাই স্বাভাবিক। সেটা কোথায় গিয়ে নামবে, সেটাই এখন উদ্বেগের বিষয়।