আর্থিক প্রতিবেদন অনিয়মে নিরীক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে আইসিএবি
দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: আর্থিক প্রতিবেদনে অনিয়ম যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড লঙ্ঘনের হিড়িক পড়েছে। অধিকাংশ কোম্পানিই বিভিন্ন খাতে আইন লঙ্ঘন করে প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে। পরিণতিতে ডিভিডেন্ড বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এছাড়াও অতালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতেও বিষয়টি নতুন কিছু নয়।
রাজস্ব ফাকি কিংবা বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা পাওয়ার জন্য আর্থিক প্রতিবেদনে হর হামেশাই অনিয়ম করা হয়ে থাকে। আর এসব বিষয়ে কোম্পানিগুলোকে অডিটররা সহযোগিতা করে থাকে। আর তাই নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানগুলোর এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে যাচ্ছে ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি)। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
তথ্যানুযায়ী, স্বল্প সময়ের ব্যবধানে অস্বাভাবিক পরিমাণ নিরীক্ষা সম্পন্ন করার প্রমাণ পাওয়া গেছে বেশকিছু নিরীক্ষকের বিরুদ্ধে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নিরীক্ষকদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা মান ও আইন লঙ্ঘনের পাশাপাশি পেশাগত অসদাচরণেরও প্রমাণ মিলেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এসব নিরীক্ষক ও নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি)।
জানা গেছে, গত বছরের শেষ প্রান্তিকে হঠাৎ করেই ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন সিস্টেমে (ডিভিএস) স্বল্প সময়ের ব্যবধানে অনেকগুলো নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন জমা পড়তে শুরু করে। বিষয়টি আইসিএবি ও ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের (এফআরসি) নজরে আসে। এফআরসির পক্ষ থেকে বেশকিছু নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে তাদের সক্ষমতার তুলনায় বিপুলসংখ্যক নিরীক্ষা করার বিষয়টি তদন্ত করে দেখার জন্য আইসিএবিকে চিঠি দেয়া হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে আইসিএবির মান নিশ্চিতকারী (কিউএডি) বিভাগ এসব নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের করা নিরীক্ষা প্রতিবেদনের গুণগত মানের বিষয়টি পর্যালোচনা করার উদ্যোগ নেয়। এক্ষেত্রে আইসিএবির পর্যালোচনায় আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা মান ও আইনের অসংখ্য লঙ্ঘনের পাশাপাশি নিরীক্ষার ক্ষেত্রে পেশাগত অসদাচরণেরও প্রমাণ পাওয়া যায়।
এছাড়া এসব নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো নিষ্পত্তি না করেই স্বল্প সময়ের মধ্যে অস্বাভাবিক পরিমাণে নিরীক্ষা সম্পন্ন করেছে। এ কারণে এসব নিরীক্ষক ও নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ডিভিএসে তাদের প্রবেশাধিকার সাময়িকভাবে স্থগিত রাখার সুপারিশ করে এফআরসি। এর পরিপ্রেক্ষিতে আইসিএবির কিউএডি বিভাগের পর্যবেক্ষণগুলো নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এসব নিরীক্ষকের ডিভিএসে প্রবেশাধিকার সাময়িকভাবে স্থগিত করে সংস্থাটি।
এফআরসির পক্ষ থেকে স্বল্প সময়ের মধ্যে অস্বাভাবিক পরিমাণে আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষার বিষয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান ও নিরীক্ষকের বিরুদ্ধে আইসিএবির কাছে অভিযোগ করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে এ মতিন অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের অংশীদার এ কে আব্দুল মতিন, আনিসুর রহমান অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের অংশীদার মো. আনিসুর রহমান,
হুদা হোসাইন অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের অংশীদার মো. আমিনুল ইসলাম এবং মোহাম্মদ আতা করিম অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের অংশীদার এএসএম আতাউল করিম ও ইমরুল কায়েস।
এছাড়া এফআরসির পক্ষ থেকে অমল অ্যান্ড লীনা চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের অংশীদার অমল কৃষ্ণ দাস, এ কে দেব অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের স্বত্বাধিকারী অঞ্জন কুমার দেব, রহমান মোস্তাফিজ হক অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের স্বত্বাধিকারী ইকরামুল হক, শফিক মিজান রহমান অ্যান্ড অগাস্টিন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের অংশীদার একেএম মিজানুর রহমান,
সিরাজ খান বসাক অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের অংশীদার চৈতি বসাক, জোহা জামান কবির রশিদ অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের অংশীদার মো. ইকবাল হোসাইন, এস এফ আহমেদ অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস, মোস্তফা কামাল অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস, রহমান ঠাকুর অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস, এ মান্নান অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস,
হাবিব সারোয়ার ভূইয়া অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস, হাফিজ আহমেদ অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস ও এমএন ইসলাম অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের নিরীক্ষাকাজের গুণগত মান যাচাইয়ের জন্য আইসিএবিকে অনুরোধ করা হয়েছে।এফআরসির চিঠি পাওয়ার পর আইসিএবি এসব নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান ও নিরীক্ষকদের নিরীক্ষাকাজের গুণগত মানের বিষয়টি তদন্তের জন্য সংস্থাটির ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড ডিসিপ্লিনারি কমিটির (আইডিসি) কাছে পাঠায়।
এরই মধ্যে তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় এমএন ইসলাম অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের অংশীদার নজরুল ইসলামের সদস্যপদ আজীবনের জন্য বাতিলের সুপারিশ করেছে আইডিসি। এছাড়া মোহাম্মদ আতা করিম অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের অংশীদার এএসএম আতাউল করিম ও ইমরুল কায়েস, এ মতিন অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের অংশীদার এ কে আব্দুল মতিন,
নিতাই চাঁদ তালুকদার ও মো. লিয়াকত আলী খান, হাফিজ আহমেদ অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের অংশীদার মো. হাফিজ আহমেদ, আনিসুর রহমান অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের অংশীদার মো. আনিসুর রহমান এবং মোস্তফা কামাল অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের অংশীদার এএইচ মোস্তফা কামালের নিরীক্ষাচর্চার সনদ (সিওপি) পাঁচ বছরের জন্য স্থগিতের পাশাপাশি ৫ লাখ টাকা করে জরিমানা আরোপের সুপারিশ করেছে আইডিসি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইসিএবির প্রেসিডেন্ট মো. শাহাদাত হোসেন এফসিএ বলেন, ডিভিএসে অস্বাভাবিক প্রবণতা পরিলক্ষিত হওয়ার পর আমাদের কিউএডি বিভাগ তথ্য সংগ্রহ করে নিরীক্ষার ক্ষেত্রে যথাযথ মান নিশ্চিত করা হয়েছে কিনা সেটি যাচাই করেছে। এক্ষেত্রে বিচ্যুতি পাওয়ায় সেগুলো তদন্তের জন্য আইডিসির কাছে পাঠানো হয়। আইডিসি তদন্ত করে এ বিষয়ে তাদের সুপারিশ কাউন্সিলের কাছে পাঠিয়েছে। কাউন্সিল এ বিষয়ে দ্রুতই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
প্রসঙ্গত, নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের স্বচ্ছতা ও যথার্থতা যাচাইয়ের পাশাপাশি জালিয়াতি প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ২০২০ সালের ১২ নভেম্বর আইসিএবির উদ্যোগে ডিভিএস সফটওয়্যারটি চালু করা হয়। এরই মধ্যে এ সফটওয়্যার ব্যবহার করে প্রকৃত আর্থিক প্রতিবেদন যাচাইয়ের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ব্যাংক, এফআরসি এবং যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মগুলোর অধিদপ্তরের (আরজেএসসি) সঙ্গে আইসিএবির সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিভিএস চালু হওয়ার কারণে জাল আর্থিক প্রতিবেদন জমা দেয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রে কিছু নিরীক্ষক যথাযথভাবে নিরীক্ষা না করেই আর্থিক প্রতিবেদন প্রত্যয়ন করে দেন। পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে তাদের প্রশ্ন করা হলে তারা নিরীক্ষা করার বিষয়টি অস্বীকার করতেন।
কিন্তু ডিভিএস চালু হওয়ার ফলে সে সুযোগ আর থাকছে না। এছাড়া কেউ যদি স্বল্প সময়ে অনেক বেশি নিরীক্ষা করে থাকেন, সেটিও ডিভিএসের মাধ্যমে সহজেই শনাক্ত করা যাবে। ফলে সব মিলিয়ে ডিভিএসের কারণে জালিয়াতির সুযোগ অনেক কমে আসছে।