পুঁজিবাজারে একের পর এক গুজব, তিন গুজবে শেয়ার বিক্রির হিড়িক!
আবদুর রহমান ও তৌফিক ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে সূচকের বড় ধরনের দরপতনের মধ্যে দিয়ে লেনদেন শেষ হয়েছে। ফলে হঠাৎ করে সূচকের বড় দরপতনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন বিনিয়োগকারীরা। সোমবার লেনদেনের শুরু থেকে ধীরে ধীরে শেয়ার বিক্রির হিড়িক পড়ে। এদিন পুঁজিবাজারে শেয়ার বিক্রির চাপে লেনদেন হওয়া প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম কমেছে। অধিকাংশ শেয়ারের দাম কমায় দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ডিএসইতে সূচক কমেছে ১৩৪ পয়েন্ট।
অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে সূচক কমেছে ৩৮৪ পয়েন্ট। আজকের এই দরপতনে দুই মাসের আগের জায়গায় চলে এসেছে পুঁজিবাজার। অর্থাৎ ডিএসইর সূচক আবারও সাড়ে ৬ হাজার পয়েন্টের নিচে চলে এসেছে। এর আগে চলতি বছরের ৮ মর্চ ডিএসইর প্রধান সূচক ছিল ৬ হাজার ৪৭৪ পয়েন্টে। আজ ১৩৪ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৪৩০ পয়েন্টে।
এছাড়া বিভিন্নভাবে সুবিধাবাদী স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য বাজারকে গুজবের মাধ্যমে অস্থিতিশীল করে তোলে এবং বাজার থেকে ফায়দা লুটতে চায়। এর বাস্তব প্রমাণ আমরা আবারও পেলাম। বাজারে এমন গুজব যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
বাজার ঘুরে একাধিক বিনিয়োগকারীর সাথে আলাপকালে বলেন, বর্তমান বাজার পরিস্থিতি নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় মধ্যে রয়েছে। গত প্রায় ৮ মাসের দরপতনে প্রায় ৪০ শতাংশ পুঁজি হারিয়েছে। এবার নতুন করে দরপতনে পুঁজি নিয়ে শঙ্কায় রয়েছি। বর্তমান পুঁজিবাজারে একের পর এক গুজব চলছে। এভাবে গুজব চলতে থাকলে বিনিয়োগকারীরা নি:স্ব হতে বেশি দিন লাগবে না।
দরপতন সম্পর্কে বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া ইস্যু যেতে না যেতেই শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে দেউলিয়াত্ব দেশের পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। শ্রীলঙ্কার মতোই বাংলাদেশের অর্থনীতি দেউলিয়া হতে পারে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়েছে পুঁজিবাজারে। সোমবার তিন ইস্যুতে গুজব ছড়িয়ে বাজারকে অস্থিরতা করা হচ্ছে। মুলত, ডলার সংকট, শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি দেউলিয়া ঘোষণা, প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার ধরা পড়ায় পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
প্রথমত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য ও জাহাজ ভাড়া বেড়ে গেছে। এতে বেড়েছে আমদানি খরচ। অন্যদিকে যেহারে আমদানি বাড়ছে একই হারে রপ্তানি না বাড়ার কারণে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি দেশের বাণিজ্য ঘাটতিতে রেকর্ড তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি বেড়ে গেছে ডলারের দাম। চরম ডলার সংকট দেখা দিয়েছে ব্যাংক খাতে। এলসি মূল্য পরিশোধ করতেও হিমশিম খাচ্ছে কিছু কিছু ব্যাংক। বিশেষ করে ছোট ব্যাংকগুলোতে সবচেয়ে বেশি ডলার সংকট রয়েছে।
বিভিন্ন কারণে এসব ব্যাংকের রপ্তানি বাণিজ্যের অগ্রগতি ঘটেনি। আমদানিতেও অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় তারা পিছিয়ে। ডলার সংকটের কারণে ঋণপত্র খুলতে বিড়ম্বনায় পড়ছে ব্যাংকগুলো। তবে যেসব ব্যাংকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেশি তাদের কাছে পর্যাপ্ত ডলার আছে। এর বিপরীতে পর্যাপ্ত রেমিট্যান্স না আসায় ডলার সংকটে পড়েছে তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলো।
দ্বিতীয়ত, ইউক্রেন-রাশিয়া ইস্যু যেতে না যেতেই শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে দেউলিয়াত্ব দেশের পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। শ্রীলঙ্কার মতোই বাংলাদেশের অর্থনীতি দেউলিয়া হতে পারে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়েছে পুঁজিবাজারে। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। এমন হয়েছে যে গত দুই থেকে তিন বছর ধরে বন্ধ থাকা বিও থেকেও শেয়ার বিক্রি করা হয়েছে। আর বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির ইস্যুকে কেন্দ্র করে দেশি বিনিয়োগকারীরাও শেয়ার বিক্রি করে অর্থ তুলে নিয়েছেন। তাতেই দরপতন হচ্ছে।
তৃতীয়ত, প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার ধরা পড়ায় পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার সঙ্গে পুঁজিবাজারে জড়িতরা ভয়-আতঙ্কে রয়েছেন। তাদের অনেকে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। তাতে বাজারে প্যানিক সেল বেড়েছে। আর এই ইস্যুগুলোকে কাজে লাগিয়ে কারসাজি চক্র কম দামে শেয়ার কিনছে। আর বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন।
এদিকে ডিএসইর তথ্য মতে, সোমবার বাজারে ৩৮১টি প্রতিষ্ঠানের ২৮ কোটি ৯৪ লাখ ১৭ হাজার ১৪১টি শেয়ার ও ইউনিট কেনাবেচা হয়েছে। এর মধ্যে ২৬টি কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে, কমেছে ৩৪৮টির, আর অপরিবর্তিত রয়েছে সাতটির। অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দাম কমায় এদিন ডিএসইর প্রধান সূচক আগের দিনের চেয়ে ১৩৪ দশমিক ৫৩ পয়েন্ট কমে ৬ হাজার ৪৩০ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। অপর দুই সূচকের মধ্যে ডিএসইএক্স আগের দিনের চেয়ে কমেছে ২১ পয়েন্ট এবং ডিএস-৩০ সূচক কমেছে ৪০ পয়েন্ট। সোমবার ডিএসইতে ১ হাজার ২১ কোটি ৬১ লাখ ৪৭ হাজার টাকার শেয়ার ও ইউনিটের লেনদেন হয়েছে।
এর আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৮২৩ কোটি ৩৬ লাখ ১১ হাজার টাকার শেয়ার। অর্থাৎ আগের দিনের চেয়ে লেনদেন বেড়েছে। এদিন সবচেয়ে বেশি দাম কমেছে ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্স, ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স, তজিম উদ্দিন টেক্সটাইল, এসিআই ফরমুলেশন, আলহাজ টেক্সটাইল, জেমিনি সি ফুড, ইস্টার্ন হাউজিং এবং আইপিডিসি লিমিটেড।
এদিন সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে শাইনপুকুর সিরামিকের শেয়ার। এরপর যথাক্রমে লেনদেন হয় বেক্সিমকো, জেএমআই হসপিটাল, আরডি ফুড, ফুওয়াং সিরামিক, এরআরবিসি ব্যাংক, ওরিয়ন ফর্মা, সালভো ক্যামিক্যাল, এসিআই ফরমুলেশন এবং লফার্জহোলসিম লিমিটেড। দেশের অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ৩৮৪ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৮৬৪ পয়েন্টে।
এ বাজারে ৩০৬টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ২৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বেড়েছে, কমেছে ২৬৭টির, আর অপরিবর্তিত রয়েছে ১০টির। এতে ৪৩ কোটি ২৭ লাখ ৬০ হাজার ৪১২ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে।