দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: বিনিয়োগকারীদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে সীমার অতিরিক্ত রিজার্ভ রাখছে পুঁজিবাজারের স্বল্প মূলধনী ৬ কোম্পানি। শুধু তাই নয় বছরের পর বছর এই রিজার্ভ বাড়িয়ে কেউ কেউ রিজার্ভের পাহাড় বানিয়ে ফেলছে। কিন্তু কেউ নজর দিচ্ছে না এই দিকে। আর দিবেই বা কিভাবে? কি পরিমাণ রিজার্ভ রাখতে পারবে কোথায় সেই রিজার্ভ ব্যয় করবে কিংবা কারা হবে এই রিজার্ভের হকদার সে ব্যাপারে বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত প্রণীত হয়নি কোনো নীতিমালা। ফলে যে যার মতো করে স্বেচ্ছাচারিভাবে একদিকে বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড বঞ্চিত করে জমানো হচ্ছে রিজার্ভ আরেকদিকে কোনো জবাবদিহিতা ছাড়াই স্বাধীনভাবে কোম্পানির লোকজন সেই রিজার্ভ ব্যয় করছে দেদারছে।

অথচ শুধু আমাদের দেশেই নয় সারা বিশ্বে প্রচলিত বিধান, কোনো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির বিনিয়োগকারীরাই সংরক্ষিত রিজার্ভে থাকা টাকার প্রকৃত দাবিদার। কারণ প্রতি বছর মুনাফার একটা অংশই যা বিনিয়োগকারীদের প্রাপ্য ছিল সেটাই রিজার্ভ ফান্ডে জমা রাখা হয়।

বিনিয়োগকারীদের পাওনা অংশকে কোম্পানির রিজার্ভ ফান্ডে জমা করে আপদকালীন ব্যয় মেটানোর পর এক সময় এই অর্থ বিনিয়োগকারীদের সমবণ্টন করে দেয়ার নিয়ম বহির্বিশ্বে চালু রয়েছে। শুধু আমাদের দেশেই কোম্পানিগুলোর রিজার্ভে থাকা অর্থ কোথায় কোন কাজে বিনিয়োগ করা হচ্ছে অথবা কে কোন খাতে খরচ করছে তা কোম্পানির মূল অংশীদার শেয়ার হোল্ডারদের থাকে অজানা। এখন দাবি উঠেছে এই টাকা আর রিজার্ভে নয়, বণ্টন করে দিতে হবে শেয়ার হোল্ডারদের।

অভিযোগ রয়েছে, কতিপয় কোম্পানির পরিচালকরা মুনাফা কম হওয়ার অজুহাতে ডিভিডেন্ডের পরিমাণ কমাচ্ছে। আর রিজার্ভের নামে অর্থ সংগ্রহ করে বিনিয়োগকারীদের ঠকিয়ে এই অর্থ আত্মসাৎ করছে। তাই বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে এসব কোম্পানিগুলোকে রিজার্ভ থেকে ডিভিডেন্ড প্রদানের পরামর্শ দিয়েছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা।

পুঁজিবাজারে বর্তমানে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা ৩৯৩টি। এরমধ্যে বেশিরভাগ কোম্পানিরই রিজার্ভ পরিশোধিত মূলধনের আশেপাশে। আবার রিজার্ভ নেই বা নেগেটিভ রিজার্ভের কোম্পানির সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। তবে পরিশোধিত মূলধনের বেশি রিজার্ভ রয়েছে, এমন কোম্পানির সংখ্যা তিনভাগের দুই ভাগের বেশি। তারমধ্যে পরিশোধিত মূলধনের ৫ গুণের বেশি রিজার্ভ রয়েছে, এমন কোম্পানির সংখ্যা ৩০-৩৫টির বেশি হবে না। তবে এর মধ্যে ৭ কোম্পানিতে রির্জাভের পাহাড় রয়েছে।

মুলত ছয় কোম্পানির নামমাত্রা বছরের পর বছর লভ্যাংশ দিচ্ছে। ছয় কোম্পানি পাহাড় সমান রিজার্ভ থাকলে বিনিয়োগকারীরা প্রকৃত ডিভিডেন্ড থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। গত চার বছরে কোম্পানিটির মুনাফায় বড় উল্লম্ফন দেখা দিলেও ডিভিডেন্ডের ক্ষেত্রে তেমন কোন উল্লফন নেই। সবকিছুই গতানুগতিক। তাছাড়া কোম্পানিগুলোর নীতিমালা না থাকায় রিজার্ভ বৃদ্ধিতে চলছে অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রতিযোগিতা। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। একটি কোম্পানির কি পরিমাণ অর্থ রিজার্ভ থাকবে তার সীমা না থাকায় রিজার্ভের পাহাড় গড়ছে।

কোম্পানিগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণ মুনাফা করলেও তা যথাযথভাবে বণ্টন না করে রিজার্ভের নামে সংরক্ষণ করছে। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা হচ্ছেন বঞ্চিত, আর পরিচালকরা এক পর্যায়ে সে রিজার্ভের মালিক হচ্ছেন।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, রিজার্ভ একটি কোম্পানির আর্থিক ভিতকে মজবুত ও শক্তিশালী করে। কোম্পানির রিজার্ভ যদি বেশি থাকে, তাহলে কোম্পানিটি যেকোনো আর্থিক বিপর্যয়ের মোকাবেলা শক্তভাবে করতে পারে।

সেক্ষেত্রে কোম্পানিটি শেয়ারহোল্ডারদের ডিভিডেন্ড দেয়ার ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতাও রক্ষা করতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে, কোনো কোম্পানির রিজার্ভ যদি কম থাকে, তাহলে কোম্পানিটি কখনো যদি অবাঞ্চিতভাবে আর্থিক বিপর্যের সম্মুখীন হয়, তাহলে সেই বিপর্যয় শক্তভাবে মোকাবেলা করতে সক্ষম হয় না। আবার শেয়ারহোল্ডারদের ডিভিডেন্ড দেয়ার ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতাও রক্ষা করতে সক্ষম হয় না।

ডিএসই তথ্যমতে, বর্তমানে পুঁজিবাজারের চার খাতের স্বল্প মূলধনী ৬ কোম্পানির পাহাড়সম রিজার্ভ রয়েছে। কোম্পানিগুলোর রিজার্ভ পরিশোধিত মূলধনের ৭ গুণের বেশি। কোম্পানি ৬টি হলো: মুন্নু সিরামিক, অ্যাপেক্স ফুডস, এএমসিএল-প্রাণ, সোনালী পেপার, সোনালী আঁশ ও নর্দার্ন জুট লিমিটেড।

মুন্নু সিরামিক : সিরামিক খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ রিজার্ভের কোম্পানি মুন্নু সিরামিক। কোম্পানিটির পরিশোধিত মুলধন ৩৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। বিপরীতে রিজার্ভ রয়েছে ২৭৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা। যা পরিশোধিত মুলধনের ৭.৩০ গুণের বেশি। এতে দেখা যায়, কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি রিজার্ভ রয়েছে ৭৩ টাকার বেশি।

অ্যাপেক্স ফুডস: রপ্তানিমুখী অ্যাপেক্স ফুডসের পরিশোধিত মুলধন ৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। বিপরীতে রিজার্ভ রয়েছে ৪৩ কোটি ২৬ লাখ টাকা। যা পরিশোধিত মুলধনের ৭.৫৫গুণ। অর্থাৎ কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি রিজার্ভ রয়েছে ৭৫ টাকার বেশি।

এএমসিএল-প্রাণ: ভোগ্যপণ্যের কোম্পানি এএমসিএল-প্রাণের পরিশোধিত মুলধন ৮ কোটি টাকা। বিপরীতে রিজার্ভ রয়েছে ৫৭ কোটি ২৭ লাখ টাকা। যা পরিশোধিত মুলধনের ৭.১৫গুণ। অর্থাৎ কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি রিজার্ভ রয়েছে ৭১ টাকার বেশি।

সোনালী পেপার: সোনালী পেপারের পরিশোধিত মুলধন ৩২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। বিপরীতে রিজার্ভ রয়েছে ৬০৮ কোটি ৩ লাখ টাকা। যা পরিশোধিত মুলধনের ১৫.৪২ গুণ। অর্থাৎ কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি রিজার্ভ রয়েছে ১৫৪ টাকার বেশি।

সোনালী আঁশ: সোনালী আঁশের পরিশোধিত মুলধন ৫ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। বিপরীতে রিজার্ভ রয়েছে ৫৬ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। যা পরিশোধিত মুলধনের ১০.৪২ গুণ। অর্থাৎ কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি রিজার্ভ রয়েছে ১০৪ টাকার বেশি।

নর্দার্ন জুট: নর্দার্ন জুটের পরিশোধিত মুলধন ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা। বিপরীতে রিজার্ভ রয়েছে ১৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। যা পরিশোধিত মুলধনের ৭.১৬ গুণ। অর্থাৎ কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি রিজার্ভ রয়েছে ৭১ টাকার বেশি।