দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: আবারও এক দিন বয়সি মুরগির বাচ্চার দাম বাড়িয়ে দিয়েছে করপোরেট কোম্পানিগুলো। মধ্য আগস্ট থেকে চলতি সেপ্টেম্বর মাসের বিভিন্ন সময়ে পর্যায়ক্রমে ব্রয়লার, লেয়ার ও সোনালি মুরগির বাচ্চার দাম ১০ থেকে ২৪ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান। দেশের বিভিন্ন জেলার প্রান্তিক খামারিরা বলছেন, এতে অচিরেই ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের দাম আরও বাড়বে। বাজারে সৃষ্টি হবে অস্থিতিশীলতা।

ইতোমধ্যে বিভিন্ন ব্যবসায়ীকে দেওয়া প্যারাগন হ্যাচারি লিমিটেডের এসএমএস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত ২০ আগস্ট এক দিন বয়সি প্রতিটি ব্রয়লার বাচ্চার বিক্রয়মূল্য ছিল যথাক্রমে এ গ্রেড ৩৫ টাকা, এ মাইনাস ৩২ টাকা ও বি গ্রেডের ক্ষেত্রে ২৭ টাকা। লেয়ার বাচ্চা (ডিমের মুরগি) বিক্রি হয়েছে ৫৬ টাকা, লেয়ার সাদা বাচ্চা ৫৮ টাকা।

কক বাচ্চা ও কক সাদা বিক্রি হয়েছে যথাক্রমে ১৩ ও ১৪ টাকা। প্যারাগন কালার ও সোনালি মুরগির বাচ্চা বিক্রি হয়েছে যথাক্রমে ৪৫ ও ২৩ টাকা। গতকাল ১৭ সেপ্টেম্বর প্যারাগনের এক দিন বয়সি এ গ্রেড একটি ব্রয়লার বাচ্চা বিক্রয়মূল্য বেড়ে হয় ৫২ টাকা। এ সময় এ মাইনাস ও বি গ্রেডের দাম ছিল যথাক্রমে ৪৯ ও ৪৪ টাকা। লেয়ার বাচ্চা (ডিমের মুরগি) ও কক বাচ্চা বিক্রি হয়েছে যথাক্রমে ৬৪ ও ২০ টাকা।

দেখা যাচ্ছে, মুরগির বাচ্চার মূল্য এ গ্রেডের ক্ষেত্রে বেড়েছে ১৪ টাকা, এ মাইনাসে ১৫ টাকা, বি প্লাসে ২২ টাকা এবং ককে (সাদা) ১০ টাকা। প্রতি দুই দিন পরপর এক-দুই টাকা করে দাম বাড়ানো হয়েছে। প্রসঙ্গত, এ গ্রেডের বাচ্চার ওজন ৪০ গ্রাম, এ মাইনাসের ৩৫ গ্রাম এবং বি প্লাসের ৩০ গ্রাম।
এ ব্যাপারে পটুয়াখালীর খামারি ইলিয়াস খন্দকার জানান, ৩ সেপ্টেম্বর প্রভিটার মুরগির বাচ্চার দাম ছিল এ প্লাস ৩৯ টাকা, বি প্লাস ৩৪ ও বি ৩১ টাকা। এই বাচ্চার দাম গতকাল ১৭ সেপ্টেম্বর বেড়ে দাঁড়িয়েছে এ প্লাস ৫০ টাকা, বি প্লাস ৪৫ ও বি ৪২ টাকা। তিনি বলেন, প্রতি দুই দিন পরপর ৪ টাকা করে বাড়িয়ে প্রতিটি গ্রেডের বাচ্চার দাম বাড়ানো হয়েছে ১১ টাকা।

নরসিংদী জেলার খামারি অলি উল্লাহ বলেন, গত ২৬ আগস্ট কাজী ফার্মের ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার দাম ছিল যথাক্রমে এ গ্রেড ৩৮ টাকা, এ মাইনাস ৩৬ টাকা, বি প্লাস ২৪-২৬ টাকা এবং কক (সাদা) ১১ টাকা। গতকাল তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে এ গ্রেড ৫২ টাকা, এ মাইনাস ৫১ টাকা, বি গ্রেড ৪৭-৪৮ টাকা এবং কক (সাদা) ২১ টাকা। অর্থাৎ কাজী ফার্মের বাচ্চার দাম বেড়েছে ১০ থেকে ২৪ টাকা পর্যন্ত। অলি উল্লাহ বলেন, করপোরেট কোম্পানিগুলো ১৫-২০ দিন আগেও ৩০ থেকে ৩২ টাকার মধ্যে মুরগির বাচ্চা বিক্রি করেছে। তখন ১ কেজি ব্রয়লারের দাম ছিল ১৪০-১৪৫ টাকা।

বর্তমানে দাম বাড়লেও ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিপ্রতি খামার পর্যায়ে একই আছে। এসব মুরগি ৩০ দিন ধরে পালন করলে ওজন দাঁড়ায় ১ কেজি ৭০০ গ্রাম। তাতে খরচ হয় ১৫০-১৫৫ টাকা। সে হিসাবে মুরগির বাচ্চা ও ব্রয়লার মুরগি বিক্রির ক্ষেত্রে খামারিদের লোকসান যাচ্ছে ১৫ টাকা।
খামারি অলি বলছেন, ‘মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ ভাগ করে দিতে হবে।

যেমন যেগুলো বাচ্চা উৎপাদন করবে, সেগুলো খাদ্য বা ওষুধ বিক্রি করতে পারবে না। আবার যেগুলো খাদ্য উৎপাদন করবে, সেগুলো বাচ্চা উৎপাদন করতে পারবে না। তা না হলে এ খাত টিকিয়ে রাখা যাবে না। কেননা করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছামাফিক বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। মুরগি যখন প্রান্তিক খামারিদের কাছে থাকে, তখন তারা দাম কমিয়ে দেয়; যখন থাকে না, বাড়িয়ে দেয়। এভাবে তারা বাজার হাতিয়ে নিচ্ছে, ভোক্তাদের জিম্মি করছে।’

চট্টগ্রামের পোল্ট্রি খামারি মো. ইকবাল হোসেন জানান, তিনি প্যারাগন গ্রুপ থেকে বাচ্চা কিনে থাকেন। ১৬ আগস্ট কোম্পানিটি ব্রয়লারের বাচ্চা ৩৫ টাকা ও লেয়ার ৫৮ টাকায় বিক্রি করেছে। ৯ সেপ্টেম্বরে বিক্রি করেছে ব্রয়লারের বাচ্চা ৪২ টাকা, লেয়ার ৫৮ টাকায়। ১১ সেপ্টেম্বর বিক্রি করেছে ব্রয়লার ৫০ টাকা, লেয়ার ৬০ টাকায়।

নারিশ পোল্ট্রি ফিড অ্যান্ড হ্যাচারি থেকে সবসময় বাচ্চা কিনে থাকেন পাবনা জেলার পোল্ট্রি খামারি সৈয়দ মোহাম্মদ আলী। তিনি জানান, ৩০ আগস্ট কোম্পানিটি ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা বিক্রি করেছে প্রতিটি ৩৮ টাকায়। … সেপ্টেম্বর করেছে ৪১ টাকায়। ১৩ ও ১৭ সেপ্টেম্বর করেছে যথাক্রমে ৪৭ ও ৫০ টাকায়। আবার লেয়ার মুরগির বাচ্চার দাম ১ আগস্ট ছিল ৫৩ টাকা; ৯ সেপ্টেম্বর সেটির দাম হয় ৬৩ টাকা। অর্থাৎ নারিশে মুরগির বাচ্চার দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১২ টাকা।

সৈয়দ মোহাম্মদ আলী বলেন, প্যারাগন পোল্ট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি লিমিটেড, কাজী ফার্মস লিমিটেড. আফতাব হ্যাচারি লিমিটেড, নারিশ পোল্ট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি লিমিটেড, আফতাব বহুমুখী ফার্মস লিমিটেড, কোয়ালিটি ব্রিডার্স লিমিটেড ও আর আর বি লিমিটেডসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানির বাচ্চা বেশি বিক্রি হয়। প্রতিটি খাদ্যের বস্তায় কন্ট্রাক্ট ফার্মিং করলে ২ হাজার ৫০০ টাকা ও প্রান্তিক খামারিদের কাছে ৩ হাজার ৫০০ টাকায় কিনতে হয়। এতে প্রতি কেজি খাদ্যে সাড়ে ৯ থেকে ১০ টাকা বেশি খরচ হয়।

বর্তমানে এ অঞ্চলে এক কেজি মুরগিতে খরচ হয় ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকা। অথচ বিক্রি হয় ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকায়। এ প্রসঙ্গে প্যারাগন গ্রুপের চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডর আঞ্চলিক অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার হেলাল উদ্দীন রাজু বলেন, ‘আমার অঞ্চলে সপ্তাহে চার দিন বাচ্চা উৎপাদন করা হয়। প্রতিদিন ৯-১০ হাজার বাচ্চা উৎপাদন করা হয়।’ মূল্যতালিকা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমাকে এসএমএস দিয়ে দাম জানান। আমি এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের সেই দাম জানিয়ে দিই। দাম কেন বাড়ল, সে সম্পর্কে কিছু বলতে পারব না।’

এ প্রসঙ্গে সি পি বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেডের চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার সেকশন ম্যানেজার কানন দাশ বলেন, ‘আমরা শুনেছি প্যারেন্ট (বাবা-মা) মুরগি আমদানি সরকারিভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এজন্য দাম বাড়ছে। প্রকৃত কারণ আমরা জানি না।’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিপিএ) সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার বলেন, ‘এক দিন বয়সি একটি ব্রয়লার বাচ্চার উৎপাদন খরচ ছিল ২৮-৩০ টাকা, সোনালি মুরগির (কালার বার্ড) উৎপাদন খরচ ছিল ২০-২২ টাকা আর লেয়ার বাচ্চার (ডিমের মুরগি) ছিল ২০-২৫ টাকা। প্রতিদিন ২৪ লাখ ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা এবং দুই লাখ লেয়ার বাচ্চা উৎপাদিত হয়।

সব মিলিয়ে হয় মোট ২৬ লাখ। এসব বাচ্চার প্রতিটি ৫০ থেকে ৭০ টাকা দামে বিক্রি করা হচ্ছে। সে হিসাবে একটি বাচ্চায় যদি গড়ে ২৫ টাকাও বেশি নেওয়া হয়, তাহলে দেখা যাচ্ছে, করপোরেট গ্রুপগুলো সিন্ডিকেট করে প্রতিদিন ৬ কোটি ৫০ লাখ টাকার বেশি হাতিয়ে নিচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘কৃষি আইনে উৎপাদকের ৩০ শতাংশ লাভ করার কথা থাকলেও করপোরেট গ্রুপগুলো ১০০ শতাংশ লাভ করছে। তারা কৃষি আইন মানছে না। সরকারের এ বিষয়ে তদারকি করা উচিত।’

সুমন হাওলাদার বলেন, ‘ফিড ও মুরগির বাচ্চায় ১০০ শতাংশ, ডিম ও মুরগির বাজারে ৬০ শতাংশ, আবার চুক্তিভিক্তিক খামারেও উৎপাদন করায় বাজার কার্যত করপোরেটদের দখলে চলে যাচ্ছে। উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিয়ে প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদন থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একই বাজারে দুই রকম দামে বাচ্চা ও ফিড বিক্রির বৈষম্য দূর করে প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদনে ধরে রাখতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘সরকারের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। তা না হলে ১ থেকে ৬ মাসের মধ্যে বাজার আবার অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে।’

এ বিষয়ে জানতে ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএবি) সাধারণ সম্পাদক ও প্যারাগন পোল্ট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুর রহমান পরে কথা বলবেন বলে জানান। তবে পরে ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।

এ সম্পর্কে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের খামার শাখার উপপরিচালক শরিফুল হককে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, তার কাছে এ ধরনের কোনো তথ্য নেই। তিনি এ ব্যাপারে পরিচালককে জানাবেন।

মুরগির বাচ্চার দাম বৃদ্ধিতে কোন ধরনের সংকট সৃষ্টি হবে, জানতে চাইলে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রিপন কুমার মন্ডল বলেন, ‘এমন অস্বাভাবিকভাবে দাম বাড়লে মুরগির মাংস ও ডিমে অবশ্যই সংকট সৃষ্টি হবে। কেননা তখন অনেক খামারি বাচ্চা তুলবে না। মাংসের ক্ষেত্রে দেড় মাসের মধ্যেই এর প্রভাব পড়বে। ডিমের ক্ষেত্রে পড়বে ৬-৮ মাসের মধ্যে।’