ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ডেঙ্গু টিকার ‘সফল’ গবেষণা

মাসুদ রানা ও ফাতিমা জাহান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ডেঙ্গু রোগের টিকা বলতে এতদিন শুধু জাপানের ‘কিউডেঙ্গা’ বা ফ্রান্সের ‘ডেঙ্গভ্যাক্সিয়া’র নামই শোনা গেছে। তবে এবার নতুন করে যুক্ত হচ্ছে যৌথভাবে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের একদল গবেষকের উদ্ভাবিত টিভি০০৫ টিকাটি। ইতোমধ্যে যার দ্বিতীয় ধাপের সফল ‘হিউম্যান ট্রায়াল’ শেষ হয়েছে। প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালের। যা আগামী মাস থেকেই শুরু হবে। এরপর চতুর্থ ধাপের ট্রায়াল সফলভাবে শেষ করতে পারলেই এটির উৎপাদনের জন্য বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন চাওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে ডেঙ্গুর টিকায় যুগান্তকারী সাফল্য আসতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন তারা।
ইতোমধ্যে টিকার নিরাপত্তা এবং এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে পারে কি না সে বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। এই টিকার অন্যতম সুবিধা এটি কয়েক ডোজ নয় বরং এক ডোজ দিলেই কাজ করবে। এর মাত্র একটি ডোজই সব ধরনের ডেঙ্গুর (ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩, ডেন-৪) বিরুদ্ধে কার্যকর হবে। আলাদা আলাদা ডোজ নেওয়ার দরকার হবে না। শিশুসহ সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এমনকি ডেঙ্গু আক্রান্ত না হলেও এই টিকা নেওয়া যাবে। আর অন্য টিকার তুলনায় এটি সস্তা হবে বলেও জানিয়েছেন গবেষকরা।
গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, প্রথমবারের মতো ডেঙ্গুপ্রবণ বাংলাদেশে একটি সম্ভাবনাময় ডেঙ্গু টিকার গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে। আইসিডিডিআরবি এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভার্মন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউভিএম) লার্নার কলেজ অব মেডিসিনের গবেষকদের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত গবেষণায় দ্বিতীয় ধাপে ১৯২ জন মানুষের মধ্যে টিভি০০৫ নামের টিকাটির সফল ট্রায়াল চালানো হয়।
জানা যায়, ২০১৫ সাল থেকে ক্লিনিকাল ট্রায়াল ও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব নিয়ে পড়াশোনাসহ পরীক্ষা চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় সক্ষমতা তৈরি করা হয়। পরে ২০১৬ সাল থেকে এর দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষা শুরু হয়। এর আওতায় এক থেকে ৪৯ বছর বয়সী ১৯২ জনের ওপর টিকা প্রয়োগ করা হয় এবং পরবর্তী ৩ বছর ধরে তাদের পর্যবেক্ষণ করা হয়। পরীক্ষায় অংশ নেওয়া সবাই স্বেচ্ছায় এতে অংশ নেন এবং তাদের দৈব-চয়ন পদ্ধতিতে অংশগ্রহণের জন্য নির্বাচন করা হয় বলে জানানো হয়।
আইসিডিডিআরবি এবং ইউভিএমের ভ্যাকসিন টেস্টিং সেন্টারের (ভিটিসি) গবেষকরা ২০১৫ সালে ‘ডেঙ্গু ইন ঢাকা ইনিশিয়েটিভ (ডিডি)’ নামক গবেষণা শুরু করে। এই সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টার লক্ষ্য ছিল ডেঙ্গু টিকার উন্নয়নে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করা। ২০১৫ থেকে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, ল্যাবরেটরি পরীক্ষণ অবকাঠামো এবং প্রারম্ভিকভাবে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব অধ্যয়ন সংশ্লিষ্ট গবেষণার জন্য আইসিডিডিআরবিতে প্রয়োজনীয় সক্ষমতা তৈরি করা হয়।
আইসিডিডিআরবির গবেষক দলের প্রধান ড. রাশিদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, টিকা দেওয়ার আগে এদের সবাইকে চারটি আলাদা ভাগে ভাগ করা হয়। এদের মধ্যে এর আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন এমন ব্যক্তিও ছিলেন। তিনি বলেন, ডেঙ্গুপ্রবণ বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো আইসিডিডিআরবি এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভার্মন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউভিএম) লার্নার কলেজ অব মেডিসিনের গবেষকরা একটি উৎসাহ ব্যঞ্জক টেট্রাভ্যালেন্ট ডেঙ্গু টিকা অর্থাৎ ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরনের বিরুদ্ধেই উপযোগী টিকা নিয়ে গবেষণা সম্পন্ন করেছেন। গবেষণায় ব্যবহৃত একডোজের ডেঙ্গু টিকা টিভি-০০৫ মূল্যায়ন করে দেখা যায় এটি শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রয়োগের জন্য নিরাপদ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে সক্ষম।
গবেষণার ফলাফল সম্প্রতি দ্য ল্যানসেট ইনফেকশাস ডিজিজেস জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত ভাইরাস যা বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে একটি বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির মৃদু লক্ষণে জ্বর এবং হাড়ের ব্যথা হয় এবং গুরুতর ক্ষেত্রে শক, রক্তপাত এবং অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুও ঘটে। সাধারণত ডেঙ্গুর চারটি ধরন (ডেন ১, ২, ৩, ৪) বা সেরোটাইপ এককভাবে বা সম্মিলিতভাবে সক্রিয় থাকতে পারে। যে কোনো সেরোটাইপই একজন মানুষকে অসুস্থ করতে পারে। তবে অন্য কোনো সেরোটাইপ দিয়ে দ্বিতীয়বার সংক্রমিত হলে আক্রান্ত ব্যক্তির অবস্থা গুরুতর হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
তাই আমাদের এই টিকা তৈরির প্রাথমিক ভাবনা এবং আমরা সাফল্যের পথে এগুচ্ছি। বাংলাদেশ, বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ (১,১১৯ জন/বর্গকিমি) দেশগুলোর মধ্যে একটি, এখানে প্রায় ১৭ কোটি লোকের বসবাস। বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এর আকার এবং তীব্রতা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বছরের চলমান ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুতর এবং ঢাকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর ভয়ানক প্রভাব ফেলেছে।
সারাদেশে ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত ১৯০,৭৫৮ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং ৯২০ জনের বেশি মৃত্যুবরণ করেছেন। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতেও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে তরল খাবার ব্যবস্থাপনা এবং উপসর্গ নিয়ন্ত্রণেই ডেঙ্গুর একমাত্র প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থা। তাই বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপের বিরুদ্ধে একটি কার্যকরী টিকা উন্নয়ন গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।
দ্য ল্যানসেট ইনফেকশাস ডিজিজেস-এ প্রকাশিত এই গবেষণাটি একটি দৈবচয়নভিত্তিক এবং ফেজ-২ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। এর মাধ্যমে টিভি-০০৫ টেট্রাভ্যালেন্টলাইভ-অ্যাটেনুয়েটেড ডেঙ্গুটিকার নিরাপত্তা, ইমিউনোজেনিসিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির সক্ষমতা এবং তিন বছর পর্যন্ত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার স্থায়িত্বের অবস্থা মূল্যায়ন করা হয়েছে।
গবেষকরা ২০১৬ থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের (বয়স১-৪৯বছর) ১৯২ জন স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণকারীকে চারটি ভাগে ভাগ করে ৩:১ অনুপাতে টিভি-০০৫ টিকা বা প্লাসিবো প্রদান করেছেন এবং পরবর্তী তিন বছর পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করেছেন।
টিকা দেওয়ার পরে বেশির ভাগ স্বেচ্ছাসেবকের মধ্যে চারটি ডেঙ্গুর সেরোটাইপের অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। যারা পূর্বে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন তাদের অ্যান্টিবডির পরিমাণ বেশি পাওয়া গিয়েছে। যদিও গবেষণাটি কার্যকারিতা মূল্যায়ন করার জন্য ডিজাইন করা হয়নি, তবে এখন পর্যন্ত টিকা প্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ডেঙ্গু সংক্রমণের কোনো ঘটনা শনাক্ত করা যায়নি।
গবেষণালব্ধ এই ফলগুলো ডেঙ্গু-প্রবণ জনগোষ্ঠীতে ব্যাপক হারে টিভি-০০৫ ডেঙ্গু টিকা ব্যবহারের জন্য উপযোগী করে তোলার পাশাপাশি, তৃতীয় ধাপের কার্যকারিতা ট্রায়াল পরিচালনার জন্য সমর্থন জোগাড় করতে সহায়তা করবে। ২০০৯ সাল থেকেই উভিএমের ভ্যাকসিন টেস্টিং সেন্টার যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের (এনআইএইচ) তৈরি ডেঙ্গুটিকার মূল্যায়ন করে আসছে।
গবেষণার বিষয়ে রাশিদুল হক আরও বলেন, একটি কার্যকর এবং টেট্রা ভালেন্ট ডেঙ্গু টিকা বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব গুরুতর হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের মানুষের অংশগ্রহণে টিভি-০০৫ টিকার গবেষণা করতে পেরে আমরা গর্বিত এবং আশা করি আমাদের কাজ ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে একটি কার্যকর টিকা প্রাপ্তি ত্বরান্বিত করবে।
তিনি বলেন, টিভি-০০৫ টিকাটি হলো একমাত্র একক ডোজের টেট্রা ভ্যালেন্ট ডেঙ্গু টিকা, যা এই টিকাটির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য- যোগ করেন কির্কপ্যাট্রিক (ইউভিএম)। তিনি বলেন, এটি ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপের সব কয়টির বিরুদ্ধেই ইমিউনরেসপন্স তৈরি করে, যা যে কোনো টেট্রা ভ্যালেন্ট ডেঙ্গু ভ্যাকসিনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। উভয় গবেষকই আশা প্রকাশ করেন যে এই গবেষণালব্ধ ফলাফল বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য উপকারী হবে।
প্রতিটি টেট্রাভ্যালেন্ট ডেঙ্গু টিকার মূল লক্ষ্য থাকে ডেঙ্গুর সব সেরোটাইপের বিপরীতে প্রয়োজনীয় ইমিউন রেসপন্স বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করা। এর আগে সানোফি ফার্মাসিউটিক্যালস এবং তাকেদা ফার্মাসিউটিক্যালসের অন্য টেট্রাভ্যালেন্ট ডেঙ্গু টিকা সফলতা পেয়েছে। ৩- ডোজের সানোফি টিকা নয় বছরের কমবয়সী শিশুদের মধ্যে যারা অতীতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে তাদের জন্য সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে২- ডোজের তাকেদা টিকাটি শুধু ডেঙ্গু সেরোটাইপ ডেন-২-এর ক্ষেত্রে সর্বোত্তম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। সারা বিশ্বে চলমান অনেক গবেষণার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ডিডি দলের দ্বারা এই টেট্রাভ্যালেন্ট ডেঙ্গু টিকার কার্যকারিতা, স্থায়িত্ব এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পর্কে গবেষণা।
তবে এখনি এই টিকার বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত নেয়া হবে তা বলতে নারাজ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এই গবেষণার বিষয়ে লিখিত কোনো কাগজ বা বিস্তারিত কিছু অধিদপ্তরকে জানানো হয়নি জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, আমরাও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবরটি দেখেছি। মাত্র দ্বিতীয় ধাপের ট্রায়াল শেষ হয়েছে। যে পরিমাণ মানুষের ওপর এই গবেষণা চালানো হয়েছে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তা খুবই সীমিত। তবে এটি আমাদের পর্যবেক্ষণে থাকবে। যদি ভালো কিছু হয় তাহলে তো খুবই ভালো।
জানা যায়, ইউভিএম টিমের নেতৃত্বে রয়েছেন অধ্যাপক বেথকির্ক প্যাট্রিক। এ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন মেরিক্লেয়ার ওয়ালশ, পিএ; ক্রিস্টেনপিয়ার্স, এমডি; ডোরোথি, এমএস; শনডিয়েল, পিএইচডি এবং মারিয়া কারমোলি। তাদের ডেঙ্গু টিকা প্রোগ্রামটি ইউভিএমভিটিসি এবং ইউএস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের ভাইরাল ডিজিজেস ল্যাবরেটরির সিনিয়র গবেষক স্টিফেন হোয়াইটহেড, পিএইচডি (যিনি একজন ভাইরোলজিস্ট এবং টিভি-০০৫ টিকার উদ্ভাবকদের একজন) এবং জনস হপকিন্স স্কুল পাবলিক হেলথের আন্না ডারবিন এমডির সঙ্গে একটি দীর্ঘ পারস্পরিক সহযোগিতার ফসল। আইসিডিডিআরবির সঙ্গে এই সহযোগিতামূলক কাজের আগে,
ইউভিএমভিটিসি সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে কয়েক ডজন গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা পরিচালনা করেছে যা মূলত ডেঙ্গু টিকার একক ও টেট্রাভ্যালেন্ট ফর্মুলেশন এবং কনট্রোলড হিউম্যান চ্যালেঞ্জ মডেলের ছিল। আইসিডিডিআরবি-গবেষকদের মধ্যে প্রধান গবেষক হিসেবে রয়েছেন সিনিয়র বিজ্ঞানী ড. রাশিদুল হক এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন মো. শফিউল আলম, সাজিয়া আফরিন এবং মো. মাসুদ আলম।