আলমগীর হোসেন ও রাকিবুল ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: আসছে অক্টোবরে সরকারের পদত্যাগসহ একদফার চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়ার পরিকল্পনায় মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। তার আগে বিভেদ-দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দলের সাংগঠনিক ভিত মজবুত ও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছে হাইকমান্ড। এরই অংশ হিসেবে সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে বহিষ্কৃত ও পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া নেতাকর্মীদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।

ইতোমধ্যে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে ক্ষমা চেয়ে অনেকেই কয়েক দফাও আবেদন করেছেন। তাদের আবেদনপত্রটি পর্যালোচনা করছেন তিনি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানসহ স্থায়ী কমিটিতে এ নিয়েও আলাপ-আলোচনা চলছে। তাদের বহিষ্কাকারাদেশ প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে অক্টোবর মাসে।

বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা জানান, একদফার চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু হয়েছে। আবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে ষড়যন্ত্র ও দল ভাঙার চেষ্টাও থেমে নেই। তৃণমূল বিএনপিতে নেয়ার জন্য নানা প্রলোভনও দেয়া হচ্ছে কাউকে কাউকে। এমন পরিস্থিতিতে বৃহত্তর স্বার্থে ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের চিহ্নিত করে তাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের জন্য সিনিয়র নেতারা হাইকমান্ডকে পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ প্রত্যাহার করা না হলে এসব নেতা সক্রিয় হতে পারছেন না। বহিষ্কৃত অনেক নেতা আছেন, যারা স্থানীয়ভাবে ব্যাপক জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী, তাদের দলে ফিরিয়ে আনা হলে আন্দোলন আরও গতিশীল হবে।

এ বিষয় জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, ‘বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করার চিন্তা-ভাবনা চলছে। অনেকে ভুল স্বীকার করে দলে ফিরতে চিঠি দিয়েছেন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাদের আবেদন গভীরভাবে দেখছেন। সবাইকে নেয়া হবে কিনা তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তারাই নেবেন। হয়তো খুব শিগগির সিদ্ধান্ত আসতে পারে।’

দলীয় সূত্রমতে, ২০১৯ সালে জানুয়ারি মাসে দলের স্থায়ী কমিটির এক সভায় এ সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। তবে দলের এ সিদ্ধান্ত অমান্য করে সিটি নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেয়ায় বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয় অনেক নেতাকে। এরপর ২০২২ সালের এপ্রিল ও মে মাসের সিটি নির্বাচন প্রশ্নে আরও কঠোর অবস্থান নেয় দলটি। সেবারও বহিষ্কৃত হন দুই শতাধিক নেতা। যদিও তাদের অনেকেই নিজস্ব শক্তির বলয়ের কারণে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন।

তবে ২০২৩ সালে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কেউ নির্বাচন করেনি। এ ছাড়াও মহানগর, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন কমিটি করার ক্ষেত্রেও মনোমালিন্যে ও বিভিন্ন অভিযোগের কারণে অসংখ্য নেতাকর্মীকে দল থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ক্ষমা চেয়ে দলের বিভিন্ন স্তরের নেতারা বিএনপিতে ফিরতে চান। বর্তমানে কেন্দ্রীয় দপ্তরে হাজারের বেশি নেতাকর্মীদের বহিষ্কার ও অব্যাহতি প্রত্যাহারের আবেদনের চিঠি জমা পড়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বহিষ্কৃত নেতাদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রিয় নেতা। তারা দীর্ঘদিন বিএনপির রাজনীতি করে আসছেন। এ ছাড়া শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যেও কয়েকজনকে ‘আজীবন বহিষ্কার’ ও অব্যাহতি দেয়া হয়। তারাও স্থানীয় রাজনীতিতে অনেক প্রভাবশালী নেতা।

এমন নেতাদের মধ্যে আছেন খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু। দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয় ২০২১ সালের ২৫ ডিসেম্বর। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ২৭টি। দলে ফিরতে পাঁচবার আবেদন করেছেন। কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মেজর (অব.) আখতারুজ্জামানকে পঞ্চমবারের মতো বহিষ্কার করা হয় ২০২২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি।

তিনিও একাধিকবার আবেদন করেছেন। একই বছরের ২০ মে কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে অংশ নেয়ায় বহিষ্কার করা হয় সাবেক মেয়র ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিরুল হক সাক্কুকে। এ ছাড়াও কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে অংশ নেয়া শতাধিক নেতাকে বহিষ্কার করা হয়।

দলটির একাধিক নেতা বলছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কাউন্সিলরসহ অন্য পদে যারা অংশ নিয়েছেন তারা সবাই দলের ত্যাগী নেতা। প্রত্যেকে হামলা-মামলায় জর্জরিত। অনেকে এলাকায় নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হয়েও অধিকাংশ জায়গাতে বিজয়ী হয়েছেন। তবে নির্বাচিত হয়েও দল ছাড়িনি। সরকার পতনের লক্ষ্যে বিএনপির প্রতিটি কর্মসূচিতে মাঠে থাকছে। তাই তাদের বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করে দলে ফেরানো উচিত।

এ বিষয় জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, জনগণ ও দলের নেতাকর্মীদের প্রশ্ন- আমাদের কি এমন অপরাধ, যার জন্য দুই বছর দলের বাইরে রাখা হলো? কমিটিতে না থাকলেও প্রায় ১০ হাজার নেতাকর্মী নিয়ে খুলনার রোডমার্চে অংশ নিয়েছি। পদ নয়, কর্মী হিসেবেও রাজপথে আছি। কারণ এই শহরের আমরাই সবচেয়ে জনপ্রিয় শহিদ জিয়ার সৈনিক। আমরা বিএনপি ছেড়ে যাইনি, আর যাবও না। আগামীতে বিএনপির একজন কর্মী হিসেবেই মরতে চাই।’

তিনি বলেন, আমরা মনে করি, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যনের কাছে অনেক ভুল তথ্য দিয়েছিল, এখন তার কাছে পর্যাপ্ত তথ্য আছে। খুলনার দায়িত্ব যাদের দিয়েছিলেন, তারা তাকে হতাশ করেছেন। দলের সবাইকে নিয়েই তিনি চূড়ান্ত আন্দোলনে নামার জন্য প্রস্তুতি নিতে বলছেন। আমরা আশাবাদী, প্রতিটি কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের নিয়ে রাজপথে সক্রিয় রয়েছি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সেই চূড়ান্ত আন্দোলনের ডাকের অপেক্ষায় আছি আমরা। খুব দ্রুত হয়তো আমাদের ডাক আসবে। সরকার পতনের আন্দোলনে রাজপথে আছি, রাজপথেই থাকব ইনশাআল্লাহ।

এ বিষয় জানতে চাইলে কুমিল্লার মনিরুল হক সাক্কু বলেন, ভুল স্বীকার করে দলের বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার চেয়ে পাঁচ থেকে ছয় মাস আগে আবেদন করেছি। কিন্তু দল থেকে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। আগামী ৫ অক্টোবর রোডমার্চে আমার নেতাকর্মী নিয়ে অংশগ্রহণ করব। আগেও প্রতিটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে আসছি। আগামী দিনে চূড়ান্ত আন্দোলনেও রাজপথে থাকব ইনশাআল্লাহ।

এ বিষয় জানতে চাইলে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে যে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে পারে। আবার দলের গণতন্ত্র মেনে কেউ যদি ক্ষমা চেয়ে আবেদন করে তাহলে দল পুনর্বিবেচনা করবে। এটাই স্বাভাবিক। কাউকে দলে ফেরানো বা বহিষ্কারাদেশ তুলে নেয়া দলের সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার অংশ। তিনি বলেন, যারা আবেদন করেছেন তাদের বিষয়ে আলোচনা চলছে। তবে কবে নাগাদ দলে ফিরতে পারেন এখনই বলা যাচ্ছে না। আশা করি, চূড়ান্ত আন্দোলনের আগে সিদ্ধান্ত আসতে পারে। কারণ এরা দলের পরীক্ষিত ও ত্যাগী নেতা।