দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দেশের অর্থনীতিতে দুঃসংবাদের শেষ নেই। ডলার সংকট, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ে নেতিবাচক প্রভাব। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়াসহ নানা সমস্যা জর্জরিত দেশের অর্থনীতি। এবার নতুন করে আরও একটা দুঃসংবাদ দিল বাংলাদেশ ব্যাংক। খেলাপি ঋণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রভিশন ঘাটতিও বেড়েছে।

দেশে চলতি বছরের জুন শেষে ৮ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ হাজার ১৩২ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোতে ব্যাপক পরিমাণে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এমনটি হয়েছে বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা। তিন মাস আগে পুরো খাতে প্রভিশন ঘাটতি ছিল ১৬ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের এপ্রিল-জুন সময়ে ৮ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ বেড়েছে ৫ হাজার ৯৭৪ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০২৩ সালের জুনে নতুন করে দুটি বেসরকারি ব্যাংক ঘাটতিতে পড়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক তিন মাসে ঘাটতিতে পড়েছে ৫১৬ কোটি টাকা। এছাড়া এনসিসি ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১১৯ কোটি টাকা।

ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ গত তিন মাসে বেড়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। যদিও এ সময় দেখা যাচ্ছে, প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ, অনেক ব্যাংককে তাদের প্রফিট থেকে প্রভিশনিং করতে হয়েছে, যে ব্যাংকগুলো প্রভিশনিং করতে পারেনি তাদের ঘাটতি বেড়ে গেছে। তারা বলছেন, ব্যাংকগুলোর ডেফারেল সুবিধা না পেলে প্রকৃত প্রভিশন ঘাটতি আরও কয়েকগুণ বেশি হবে।

ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের মধ্যে যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করে থাকে, তার বেশিরভাগই আমানতকারীর অর্থ। আমানতকারীদের অর্থ যেন ঝুঁকির মুখে না পড়ে, সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা আছে। এর একটি হলো প্রভিশন সংরক্ষণ।

সাধারণত খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। তিন ধরনের খেলাপি ঋণ রয়েছে। ১) সাব স্ট্যান্ডার্ড (এসএস) বা মন্দ মানের খেলাপি ঋণ; ২) ডাউট ফুল (ডিএফ) বা সন্দেহজনক মানের ঋণ এবং ৩) ব্যাড অ্যান্ড লস (বিএল) বা কু ঋণ। তিন ধরনের খেলাপি ঋণের বিপরীতে যথাক্রমে ২০ শতাংশ, ৫০ শতাংশ এবং ১০০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোকে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।

এছাড়া অশ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে পরিচালন মুনাফার শূন্য দশমিক পাঁচ থেকে পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। প্রভিশন ঘাটতি থাকলে শেয়ার হোল্ডারদের মধ্যে লভ্যাংশ ঘোষণা করা যায় না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক খাতে সর্বোচ্চ প্রভিশন ঘটতি রয়েছে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক। ব্যাংকটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে। ব্যাংকটির ঘাটতির পরিমাণ ১১ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। এছাড়া অগ্রণী ব্যাংকের চার হাজার ৪৬৫ কোটি, বেসিক ব্যাংকের চার হাজার ৩১০ কোটি, রূপালী ব্যাংকের চার হাজার ৯৭ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৫১৬ কোটি, ঢাকা ব্যাংকের ৪৩৯ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ২০৪ কোটি ও এনসিসি ব্যাংকের ৪১৯ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে।

প্রভিশন ঘাটতি থেকে বের হয়ে গেছে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। আর নতুন করে প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে বেসরকারি এনসিসি ব্যাংক। করোনা মহামারির অভিঘাত এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে অর্থনীতি সংকটে পড়েছে। এর প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। আগের একই পরিমাণ জ্বালানি ও খাদ্য পণ্য আমদানি করতে ৩০ থেকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে।

ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ ছাড় দেয়ার পরও এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যায়নি। এপ্রিল-জুন তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় সাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গত জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা; যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এযাবৎ কালের সর্বোচ্চ। খেলাপি ঋণের হারও ১০ শতাংশ অতিক্রম করেছে।

নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো আমানতের বিপরীতে ০.৫০ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখতে হয়। তবে খেলাপি ঋণের মান অনুযায়ী, ২০ শতাংশ, ৫০ শতাংশ, এমনকি শতভাগ পর্যন্ত প্রভিশন রাখার নীতিমালা রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, চলতি জুন প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ রাষ্ট্রায়ত্ত কিছু ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ব্যাপক বেড়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ তিন মাসের ব্যবধানে দ্বিগুণ হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, জনতা ব্যাংক থেকে বড় একটি রপ্তানিকারক গ্রুপ ইডিএফএ’র ঋণ নিয়ে সেগুলো দীর্ঘদিন যাবৎ ফেরত না দেয়ায় ব্যাংক বাধ্য হয়ে প্রতিষ্ঠানটির ঋণ খেলাপি করেছে। যা তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ার আরেকটি কারণ হলো চলতি বছরের এপ্রিলে ঋণ স্থগিতের সুবিধা তুলে নিয়ে কিছু ইডিএফ (রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল) ওভারডিউ গ্রাহকদের খেলাপি হিসেবে দেখানো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসে ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, যা মোট বকেয়া ঋণের ১০.১১ শতাংশ।

মার্চ মাসে ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা, যা মোট বকেয়া ঋণের ৮.৮০ শতাংশ। জুন শেষে বকেয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। দেশের ব্যাংকিং খাতে এমন সময়ে খেলাপি ঋণ ও প্রভিশন ঘাটতি বেড়েই যাচ্ছে, যখন বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের কম রাখতে হচ্ছে।

২০২৬ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর গড় এনপিএল অনুপাত ১০ শতাংশের নিচে এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ৫ শতাংশের নিচে কমিয়ে আনার ব্যাপারে আইএমএফের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খালাপি ঋণের পরিমাণ রয়েছে ২৫ শতাংশ।

এছাড়া, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ৬ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে। এর আগে দেশের ১৬টি ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ সুবিধায় প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি ডেফারেল সুবিধা ১ থেকে ৯ বছর সময়ের জন্য ভোগ করছে বলে উঠে আসে। এসব ব্যাংকের বেশির ভাগই রাষ্ট্রায়ত্ত।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংক যদি প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়, তবে তাদের মূলধন ঘাটতিতে পড়ার শঙ্কা থাকে। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ব্যাংকের ওপর। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায় আমানত। গ্রাহকের আমানতের সুরক্ষায় ব্যাংকগুলোর যথাযথ প্রভিশন নিশ্চিত করা দরকার।