দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: বাংলাদেশ ভারতের পরীক্ষিত বন্ধু। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে এ বন্ধুত্ব নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, বিচ্ছিন্নতাবাদী, মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদ ভারতের নিরাপত্তার জন্য বারবার বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এমন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদীদের প্রশয় না দেয়ার বিষয়ে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখিয়ে আসছে বর্তমান সরকার। এর বাইরে যারা ক্ষমতায় এসেছেন, তাদের বিরুদ্ধে সীমান্ত সন্ত্রাসবাদীদের প্রশয় দিয়ে ভারতের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলার অভিযোগ দীর্ঘদিনের।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক রক্তের। বাংলাদেশ ও ভারত দক্ষিণ এশিয়ার দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র হলেও এ দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে যাওয়ার পরে বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পাকিস্তান প্রজাতন্ত্রের অংশ ছিল।

পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শাসনের নিষ্পেষণে পূর্ব বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যখন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তখন ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তার সরকার যে সহায়তা করেছিল তা বাংলার মানুষ কখনো ভুলবে না। বাংলাদেশের ‘গণতান্ত্রিক পরম্পরা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার’ প্রতি ভারত বহু বছর ধরে যে জোরালো সমর্থন দিয়ে আসছে তা আগামী দিনেও পুরোপুরি অব্যাহত থাকবে বলে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

এছাড়া যেকোনো রাষ্ট্র সবার আগে তার নিজ ভূখণ্ডের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সহযোগিতা। এ বিষয়ে নয়াদিল্লির প্রতি অকুণ্ঠভাবে সেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ঢাকা। ২০০৯ সাল থেকে ভারতকে তার উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দমনে বাংলাদেশ যে সহযোগিতা করে আসছে তাতে বাংলাদেশের সরকারের ওপর আস্থা বেড়েছে প্রতিবেশী দেশটির সরকারের।

অতিসম্প্রতি নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রার বক্তব্যে সেই আস্থার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে আরও একবার। বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ভারতের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশার পরিপ্রেক্ষিতে নয়াদিল্লি মনে করে, নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু এবং মানুষ যেভাবে চায় সেভাবেই ভোট হওয়া উচিত এবং এখানে অন্য কোনো তৃতীয় পক্ষের নাক গলানো ঠিক নয়।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ভারত আরও একবার বন্ধুত্বের পরিচয় দিল। আসন্ন নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো যখন বাংলাদেশকে চেপে ধরেছে তখন ভারত দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিল, এটি একান্তই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এখানে অন্য কারও হস্তক্ষেপ ঠিক নয়। ভারত আরও বলেছে, বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে নির্বাচন চায় সেভাবেই হওয়া উচিত, বাংলাদেশের মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলনের প্রতি ভারতের সমর্থন ও আস্থা রয়েছে।

এ আস্থা গড়ে ওঠার পেছনের কারণ হচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ভারতকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে এবং করছে। ২০০৯ সালের আগে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলো অশান্ত ছিল, সেখানে প্রচুর সন্ত্রাসী ও চরমপন্থি কর্মকাণ্ড চলছিল।

কিন্তু ওই সময় থেকে বাংলাদেশ সরকার সহযোগিতা করার ফলে ভারতের ওই রাজ্যগুলো নিরাপদ হয়েছে, সেখানে সন্ত্রাসী ও চরমপন্থা নিয়ন্ত্রণে সমর্থ হয়েছে ভারত সরকার। এ কারণে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছার ওপর বাংলাদেশকে ছেড়ে দিতে সম্মত হয়নি। নয়াদিল্লি স্পষ্টভাবেই বলেছে, নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারত তাদের অবস্থান আরও আগেই পরিষ্কার করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের দুজন করে মন্ত্রীর মধ্যে বৈঠক শেষে ভারত আবারও স্পষ্ট করল। এর মধ্য দিয়ে মূলত বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ওপর ভারতের যে আস্থা আছে তা আবারও প্রকাশ পেল।

কারণ নয়াদিল্লি মনে করে, বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সময়ে ভারতের কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই। বাংলাদেশ সন্ত্রাসী ইস্যুতে অনেক আগেই জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছে। এখানেই মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে। এর আগে আওয়ামী লীগ ছাড়া বাংলাদেশে অন্য যে দলগুলো সরকার পরিচালনা করেছে তাদের ওপর ভারতের নিরাপত্তা আস্থার সংকট ছিল।

যেমন ওই সময়ে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক, বাংলাদেশে অনুপ চেটিয়া এবং উলফা বাহিনীর ঘোরাফেরা ইত্যাদি ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের রাজ্যগুলোর জন্য নিরাপত্তা হুমকি হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী সরকারের বর্তমান সময় পর্যন্ত সেই নিরাপত্তা অনেকটাই নির্ভার ভারত সরকার। তাই যুক্তরাষ্ট্রের ফাঁদে পা দিয়ে তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে নিজেদের নিরাপত্তা ঝুঁকি নিতে চায় না ভারত।

যুক্তরাষ্ট্র ভারতের অনেক বড় বন্ধু, কিন্তু তাই বলে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সব চাওয়া মেনে নেবে এটা ঠিক নয়, যা দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের আগেও পরিষ্কার করেছে নয়াদিল্লি। তবে এটা দুর্ভাগ্যজনক যে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে দুই দেশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ সাহান বলেন, ২+২ মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারত যে মতামত দিয়েছে, তা নতুন কিছু নয়। এর আগেও ভারত বাংলাদেশ নিয়ে একই অবস্থান পরিষ্কার করেছিল। বাংলাদেশ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে অবস্থানে আছে, তার সঙ্গে ভারতের ভিন্নমত রয়েছে। আর এখানে ভূ-রাজনীতির বিষয়ও আছে।

তবে বল এখন ভারতের কোর্টে। যুক্তরাষ্ট্র এখন চেষ্টা করবে এখান থেকে সম্মানজনকভাবে বের হওয়ার। বাংলাদেশ হচ্ছে ভারতের সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী। দুই দেশ একসঙ্গে ৪ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি সীমান্ত অংশ শেয়ার করে, যা বিশ্বের মধ্যে পঞ্চম। বাংলাদেশের সহযোগিতার কারণে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল শান্ত রয়েছে। এ কারণে ভারত বাংলাদেশের ওপর আস্থাশীল। এ ছাড়া দুই দেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক এবং বাংলাদেশ অভ্যুদয়ে ভারতের সহযোগিতা ছিল।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. ওয়ালিউর রহমান বলেন, ভারত খুবই সহজ কথা বলেছে। নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু, যেখানে অন্য কারও কথা বলা ঠিক নয়। ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে আরও বলেছে, বাংলাদেশে ভালো নির্বাচন হবে, বাংলাদেশে যে সরকার ক্ষমতায় রয়েছে তারা ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের ওপর ভারতের আস্থা রয়েছে। তবে বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একমতে পৌঁছতে পারেনি। এতে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি নেই।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ২+২ বৈঠকে বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারত যেভাবে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে, তা বাংলাদেশ সরকারের কনফিডেন্স আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের দুই রকম স্বার্থ রয়েছে। ভারত তার স্বার্থ বিবেচনা করেই বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তাভাবনার সঙ্গে একমত হয়নি। বরং ভারত চায় বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ধারাবাহিকতা থাকুক, তাতে তার নিরাপত্তা বজায় থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করার জন্য ভারত আঞ্চলিক ইস্যুতে ছাড় দিতে চায় না।

গত শুক্রবার নয়াদিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ২+২ মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক শেষে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বলেন, একটি স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে সে দেশের মানুষ যেভাবে দেখতে চায়, সেই ‘ভিশন’কে ভারত কঠোরভাবে সমর্থন করে। বাংলাদেশের নির্বাচন সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং সে দেশের মানুষই তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।

বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই স্পষ্ট করে তুলে ধরেছি আমরা। তৃতীয় কোনো দেশের নীতিমালা নিয়ে আমাদের মন্তব্য করার জায়গা নেই। এক বন্ধু এবং সঙ্গী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সম্মান জানায় ভারত।