দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক জটিলতায় পড়েছে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ অনেকটা স্বস্তিতে রয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, নির্বাচনের কাছাকাছি সময়ে এসে অগোছালো হয়ে পড়েছে বিএনপি। বিশেষ করে গত ২৮ অক্টোবরের পর নেতৃত্বহীনতায় ভুগছে দলটি। ছন্নছাড়া ও দিকহীন হয়ে পড়েছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা। বিদেশিদের গলার সুরও নরম হয়ে গেছে। আর নির্ভার আওয়ামী লীগ রয়েছে নির্বাচনী আবহে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন নিয়ে বিপাকে পড়েছে বিএনপি। এক দফার যুগপৎ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় উল্লেখযোগ্যভাবে গত ২৮ অক্টোবর বড় ধরনের কর্মসূচি পালন করে দলটি। আর ওই কর্মসূচিই তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। এর আগে টানা ১৫ দিনব্যাপী ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত কর্মসূচি পালন করে দলটি। কর্মসূচির মধ্যে রোডমার্চ এবং সমাবেশ ছিল।

গত ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকায় গণমিছিল করে বিএনপি। সরকারবিরোধী বিভিন্ন দল, জোট ও বিএনপির সমমনারাও নিজ নিজ অবস্থান থেকে এ কর্মসূচি পালন করে। সেটি ছিল সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের বিএনপির ষষ্ঠ কর্মসূচি। এর আগে এক দফা আন্দোলনের পঞ্চম কর্মসূচি ছিল গত ২৫ আগস্ট। ওই দিন বিএনপি এবং সরকারবিরোধী বিভিন্ন দল, জোট ও বিএনপির সমমনারা ঢাকায় কালো পতাকা মিছিল কর্মসূচি পালন করে।

গত ১২ জুলাই নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ থেকে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের ঘোষণা দেয় বিএনপি। এরপর থেকে এক দফা দাবি আদায়ে রাজপথে ধারাবাহিক আন্দোলন কর্মসূচি পালন করছে দলটি। এ সব কর্মসূচিতে সরকারবিরোধী জোটগুলোও সংহতি জানাচ্ছে। এক দফা ঘোষণার পর গত ২৮ জুলাই ঢাকায় মহাসমাবেশ এবং ২৯ জুলাই ঢাকার সব প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে বিএনপি।

এর আগে গত ১১ ও ১৮ আগস্ট গণমিছিল হয়। সরকার এবার বিনা চ্যালেঞ্জে একতরফা নির্বাচনের দিকে যাতে এগোতে না পারে, সে ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করা সম্ভব হবে বলে বিএনপির নেতাকর্মীদের বড় অংশ মনে করছে। তবে মাঠের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারকে কতটা টলানো যাবে, সেই সন্দেহও রয়েছে বিএনপির ভেতরে।

কারণ, ঢাকায় বড় জমায়েতের মহাসমাবেশ করার পরদিনই গত ২৯ জুলাই রাজধানীর প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচিতে বিএনপির নেতাকর্মীদের জমায়েত সেভাবে ছিল না। দলটির নগণ্যসংখ্যক নেতাকর্মী সেদিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও পুলিশের মারমুখী অবস্থানের মুখে মাঠে থাকতে পারেননি। সেই পরিস্থিতি ছিল তাদের জন্য একটা বড় ধাক্কা। একধরনের হতাশাও তৈরি হয়েছিল এবং একটা ছন্দপতন হয়েছিল এক দফার আন্দোলনে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর দলটির নেতৃত্বের একধরনের নির্ভরশীলতার বিষয়ও অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশ পাচ্ছে।

সর্বশেষ গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ করতে গিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে বিএনপি। পাল্টে যায় দেশের রাজনৈতিক চিত্র। বদলে যায় রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ। দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। মামলা-হামলায় ভয়ে সম্মুখে আসছেন না মাঝারি সারির নেতারা।

গত ১২ দিন ধরে জনশূন্য অবস্থায় পড়ে আছে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়। কার্যকর দিক নির্দেশনা ও নেতৃত্বের সংকট অনুভব করছেন তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকমীরা। ইতোমধ্যে তিন দফা অবরোধের শেষ দিন পার হয়েছে বৃহস্পতিবার। অবরোধ ঘোষণা দিয়ে মাঠে ছিলেন না দলটির নেতাকর্মীরা। এদিকে মার্কিন ভিসানীতি ঘোষণার পর একের পর এক আন্তর্জাতিক চাপে পড়েছিল আওয়ামী লীগ।

বিদেশি কূটনীতিকদের আগমনে সেই চাপ যেন বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। বিএনপির দাবিগুলোর এবং বিদেশি কূটনীতিকদের আচরণ ও ভাষা এক পর্যায়ে মিশে একাকার হয়ে যায়। পশ্চিমাবিশ্বের আওয়ামী লীগ বিরোধী অবস্থান আরো সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। বিদেশিদের ভরসায় বেড়ে যায় বিএনপির আন্দোলনের গতি। কিন্তু গত ২৮ অক্টোবরের সংঘর্ষে তৈরি হয়েছে নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।

পুলিশসহ একাধিক ব্যক্তির মৃত্যু এবং অবারোধের নামে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় বিব্রত হয়ে পড়ে পশ্চিমাবিশ্ব। কমে যায় তাদের হুঙ্কার। নেমে আসে তাদের গলার সুর। কমে যায় বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দৌড়ঝাঁপ। এ সুযোগে ঘুরে দাঁড়ায় আওয়ামী লীগ। পুরোপুরিভাবে দখলে নেয় রাজনৈতিক মাঠ। ২৮ অক্টোরের সংঘর্ষ এবং পরবর্তী সময়ে পরিবহনগুলোতে সংযোগের সকল দায় গিয়ে পড়ে বিএনপি-জামায়াতের ওপর।

আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ ঘিরে সহিংসতার পরদিন হরতাল এবং এক দিন বিরতি দিয়ে টানা যে অবরোধ বিএনপি, জামায়াত ও সমমনারা ডেকে আসছে, তা ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে আসছে। বিএনপির নির্বাচনে আসার তুমুল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার চেয়ে বিএনপি ও সমমনাদের অবরোধ দিনের পর দিন বেড়ে চললেও এ দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই সরকারের। সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করার বিষয়ে অটল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করছেন, ওই অবরোধ ভেঙে পড়বে ২০১৫ সালের মতোই। তফসিলের আগে আগে নির্বাচন কমিশন আলোচনার জন্য যে ৪৪টি দলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে যে ২৬টি দল সভায় এসেছিল, তারা ভোটে আসছে- এটা ধরে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এখন চেষ্টা চলছে আরও কিছু দলকে এই পথে আনা যায় কিনা।

তফসিল ঘোষণার আগে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সাক্ষাতের দিন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের বৈঠক ডাকেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবারের এ বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে জানিয়েছেন নেতারা।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক বলেন, দেশে সংবিধান অনুযায়ী সময়মতো সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। বিএনপি বা কেউ নির্বাচনে না এলে তাতে কিছু যায় আসে না। বিএনপি না এলেও নির্বাচন আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। দলীয়ভাবে না এলেও তাদের একাংশ নির্বাচনে আসতে পারে ও অন্যান্য দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। আন্তর্জাতিক বিশ্ব নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণ করেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অবস্থান: বিএনপির সাবেক নেতাদের দল তৃণমূল বিএনপির নির্বাচনে আসার ঘোষণা এবং একই দিন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজউদ্দিন আহমেদ যা বলেছেন, তাতে আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করছেন, বিএনপি ভোটে না এলেও দলটির অনেক নেতাই নিবন্ধিত দলে যোগ দিয়ে ভোটে আসবেন।

তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার তো প্রকাশ্যেই বলেছেন, তার দল চমক দেখাবে। বিএনপির অনেক পর্যায়ের নেতারাই তাদের দলে আসবেন। দলের চেয়ারপারসন শমসের মবিন চৌধুরী এরইমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, তারা ভোটে যাচ্ছেন এবং ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেয়ার চেষ্টা থাকবে। জাতীয় পার্টি নিয়েও নির্ভার হয়েছে আওয়ামী লীগ।

তারা মনে করে, ২০১৪ সালে দলটি নির্বাচনে অংশ নেয়া নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত থাকলেও এবার এ ক্ষেত্রে দলে কোনো মতবিরোধ নেই। জাতীয় পার্টির নেতা ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য সৈয়দ আবুল হোসেন বাবলা এরইমধ্যে লাঙ্গল প্রতীকে ভোট চেয়ে জনসভা করেছেন।

দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের গত ৪ নভেম্বর এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আমরা নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গেই আছি। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা ঘোষণা দিয়ে চলে যাব, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে আছি, আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। একই প্রশ্নে ১৪ দলের শরিক বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, নির্বাচন হলে সেটা গ্রহণযোগ্য না হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর বিএনপিকে নির্বাচনে আসতে হবে এমন কোনো আইন তো নেই, তাহলে বিএনপি নির্বাচনে না এলে গ্রহণযোগ্য হবে না এটা কীভাবে বলে লোকজন।