দুই ইস্যুতে পুঁজিবাজার ছাড়ছেন বিনিয়োগকারীরা, ৮৫ পয়েন্ট সূচক উধাও
দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতার স্বার্থে সরকারসহ বিএসইসির নানামুখী উদ্যোগের পরও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। বরং দিন যতই যাচ্ছে লোকসানের পাল্লা ততই ভারী হচ্ছে। ফলে সকলের মাঝে বাজার পরিস্থিতি নিয়ে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। তাছাড়া বর্তমান বাজারে অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশ থাকলেও প্রায় প্রতিদিনই নিম্নমুখী হচ্ছে বাজার। সেই সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই কমছে বাজার মূলধন।
যে কারণে বিনিয়োগ নিয়ে দোলাচলে পড়ছেন বিনিয়োগকারীরা। সম্প্রতি আবারও বাজারে দীর্ঘমেয়াদি পতন দেখা দিয়েছে। ফলে সব শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন অনেক বিনিয়োগকারী। কারণ আজও সপ্তাহের দ্বিতীয় কার্যদিবসে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ৮৫ পয়েন্ট সূচকের উধাও হয়ে গেছে।
একাধিক বিনিয়োগকারীর সাথে আলাপ কালে জানা যায়, মূলত দুই কারণে বাজার ছেড়ে যাচ্ছেন তারা। এর মধ্যে প্রথম কারণ বাজারে স্থিতিশিল পরিবেশ না থাকা। অথাৎ পুঁজির নিরাপত্তা পাচ্ছেন তারা। লাভের বদলে লোকসানের হিসাব কষতে হচ্ছে তাদের। দ্বিতীয় কারণ ব্যাংকে সুদের হার বেড়ে যাওয়া। এখন বেশিরভাগ ব্যাংকে যে সুদ দেয়া হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের মতে তা পুঁজিবাজারের চেয়ে অনেক ভালো।
তাদের ভাষ্য এখানে টাকা রাখলে অন্তত্য লোকসানের হিসাব করতে হবে না। মাস শেষে কিছু হলেও লাভ পাওয়া যাচ্ছে। পাশাপাশি টেনশন কমে যাবে। যে কারণে তারা পুঁজিবাজার ছেড়ে ব্যাংকের দিকে ধাপিত হচ্ছেন। বর্তমানে ব্যাংকে আমানত রেখে ১০ থেকে ১৩ শতাংশের বেশি সুদ পাওয়া যাচ্ছে।
ব্যাংকঋণের সুদের হার বাড়ছে। কোনো কোনো ব্যাংকে ঋণের সুদের হার ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এর প্রভাবে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহারও বাড়াতে শুরু করেছে। মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, ঋণ আদায়ে মন্দা ও ভাবমূর্তি সংকটের কারণে কিছু ব্যাংক আগে থেকেই তারল্যসংকটে ছিল। তারা বাড়তি সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহ করছিল। এখন মোটামুটি সব ব্যাংক আমানতের সুদহার বাড়িয়েছে। ফলে ব্যাংকে টাকা জমা রেখে ভালো মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে । কোনো কোনো ব্যাংকে সাড়ে পাঁচ বছরে টাকা দ্বিগুণের প্রতিশ্রুতি। বেশি সুদ দেওয়া ব্যাংকগুলো তারল্যসংকটে।
পুঁজিবাজার ভালো হবে এই আশায় মন্দা পরিস্থিতির মধ্যেও বাজারের সাথে যুক্ত হয়েছেন অনেক বিনিয়োগকারী। নতুন বিনিয়োগও করেছেন অনেকে। কিন্তু দেখতে হয়েছে ভিন্ন পরিস্থিতি। লাভের আশায় বিনিয়োগ করে উল্টো লোকসানের হিসেব কষতে হয়েছে তাদের। যার পরিপ্রেক্ষিতে এখন সিদ্ধান্ত বদল করছেন তারা। সর্বস্ব হারিয়ে পুঁজিবাজার ছেড়ে যাচ্ছেন এইসব বিনিয়োগকারী।
স্টক বন্ডের বিনিয়োগকারী আতাউর রহমান বলেন, বাজার ভালো হবে এমন আশায় পুঁজিবাজারে টিকে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে পরিস্থিতি ততই নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে বাজার ছেড়ে চলে যেতে হবে। যারা চলে গিয়েছে তাদের এখন আর লোকসানের চিন্তা করতে হবে না।
সাম্প্রতিক বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, টানা পতনের পর ঈদের আগে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ায় পুঁজিবাজার। ঈদের আগের শেষ দুই কার্যদিবসে দেশের পুঁজিবাজার ঊর্ধ্বমুখী ছিল। এই দুই দিনে বেশির ভাগ শেয়ারেরই দাম বেড়েছে। যার জের ধরে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স প্রায় ৬৮ পয়েন্ট বেড়েছে। তা সত্ত্বেও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট যেন কাটছে না। দাম বাড়লেও বিনিয়োগকারীরা বাজার ছেড়ে যাচ্ছেন।
প্রাপ্ত তথ্য মতে ঈদের ছুটি শুরু হওয়ার আগে ছয় কার্যদিবসে পুঁজিবাজার ছেড়েছেন চার হাজারের বেশি বিনিয়োগকারী। এই ছয় দিনে এসব বিনিয়োগকারী তাঁদের বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাবে থাকা সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। এতে বাজারে সার্বিকভাবে শেয়ারশূন্য বিও হিসাবের সংখ্যা আরও বেড়েছে। সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল)। প্রতিষ্ঠানটির বিও হিসাবসংক্রান্ত পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজার ছেড়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
সিডিবিএলের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩১ মার্চ পুঁজিবাজারে শেয়ারশূন্য বিও হিসাবের সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৫২ হাজার ৬২৯। ঈদের ছুটির আগের সর্বশেষ কার্যদিবস ৯ এপ্রিলে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৬৪৩–এ। সেই হিসাবে ১ থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ছয় কার্যদিবসে শেয়ারশূন্য বিও হিসাবের সংখ্যা বেড়েছে ৪ হাজার ১৪। অর্থাৎ এসব হিসাবের সব শেয়ার বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
ঈদের ছুটি শুরু হওয়ার আগের দুই দিন বাজার ইতিবাচক ধারায় থাকার পরও বিও হিসাবের সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন অনেক বিনিয়োগকারীরা। এর বিপরীতে দুই দিনে খোলা হয়েছে ৩৫৩টি বিও হিসাব। অর্থাৎ যে হারে বিনিয়োগকারীরা বাজার ছাড়ছেন, সে তুলনায় নতুন বিনিয়োগকারী আসছেন কম।
বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, টানা দরপতনে পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা চরমে পৌঁছেছে। এ কারণে আরও লোকসান হতে পারে, এমন ভয়ে বিনিয়োগকারীরা বাজার ছাড়ছেন। এ ছাড়া পুঁজিবাজারের চেয়ে এখন ব্যাংকে টাকা জমা রেখে বেশি মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে টাকা খোয়ানোর ঝুঁকিও নেই। তাই অনেকে পুঁজিবাজার ছেড়ে উচ্চ সুদে তা ব্যাংকে রাখছেন। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পুঁজিবাজারে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসইর একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আসলে বহুদিন থেকে পুঁজিবাজারের সার্বিক পরিস্থিতি ভালো নয়। যে কারণে অনকেই পুঁজিবাজার নিরাপদ মনে করছেন না। তাই তারা এই বাজার ছেড়ে যাচ্ছেন। কারণ সবাই তার পুঁজির নিরাপত্তা চান। তবে বাজার যদি দীর্ঘমেয়াদি ভালো হয় তবে তাহলে হয়তো পরিস্থিতি পাল্টাবে।
সিডিবিএলের হিসাবে, পুঁজিবাজারে এখন সক্রিয় বিও হিসাবের সংখ্যা ১৭ লাখ ৮৭ হাজার ৮৪৩। এর মধ্যে শেয়ার আছে ১৩ লাখ ৫৫ হাজার ২৫৫টি হিসাবে। বাকি বিও হিসাবগুলো কাগজে-কলমে সক্রিয় দেখালেও বাস্তবে কোনো শেয়ার নেই।