দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: হঠাৎ করেই বেশ অস্থির হয়ে উঠেছে ভারতের পুঁজিবাজার। মূল্যসূচকের বড় ওঠা-নামা নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে গত এক মাসে বাজারে অস্থিরতা বেড়েছে। অথচ গত মাসের শুরুর দিকেই বাজার রেকর্ড উচ্চতায় উঠে এসেছিল। তাহলে হঠাৎ করে বাজার এমন অস্থির হয়ে উঠল কেন? বিশ্লেষকদের মতে এর পেছনে রয়েছে দেশটিতে চলমান জাতীয় নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি। নির্বাচনী আবহের রঙ বদলের সাথে সাথে বাজারে তার প্রভাব পড়ছে। আর এটিকেই এখন মোক্ষম অস্ত্র বানাতে চাচ্ছে হঠাৎ অথৈ জলে পড়ে যাওয়া বিজেপি।

গত ১০ এপ্রিল বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান মূল্যসূচক সেনসেক্স (এসঅ্যান্ডপি বিএসই সেনসেক্স) ৭৫ হাজার ৩৮ পয়েন্ট ওঠে রেকর্ড গড়েছিল। কিন্তু এর পর থেকেই এ সূচক নিম্নমুখী হতে থাকে। কিছুটা ওঠা-নামার মধ্য দিয়ে আজ (২১ মে) তা ৭৩ হাজার ৯৫৩ পয়েন্টে স্থির হয়। গত ১৫ দিনে এ সূচক সর্বনিম্ন ৭২ হাজার ৪০৪ পয়েন্ট থেকে সর্বোচ্চ ৭৩ হাজার ৯৫৩ পয়েন্টের মধ্যে ওঠা-নামা করেছে। সূচকের এই ওঠা-নামাকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন বিজেপি ও প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে শুরু হয়েছে তীব্র বাহাস।

ভারতে ১৮তম লোকসভার নির্বাচনের ভোটগ্রহণ গত ১৯ এপ্রিল শুরু হয়েছে। সাত পর্বে এই ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যা ১ জুন শেষ হবে। ইতোমধ্যে ৫ম পর্বের ভোটগ্রহণ সমাপ্ত হয়েছে। ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোটের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হচ্ছে।

ভোটগ্রহণ শুরুর দুই সপ্তাহ আগেও সামগ্রিক পরিবেশে মনে হচ্ছিল, বিজেপির নেতৃত্বধীন এনডিএ জোট নিশ্চিতভাবে ফের ক্ষমতায় আসছে। গত নির্বাচনের চেয়ে গত বেশি আসন নিয়ে ক্ষমতায় আসবে সেটি নিয়েই বরং চলছিল আলোচনা। গত বছর ৩০৩ জন এমপি নিয়ে ক্ষমতায় আসা বিজেপি জোর গলায় দাবি করছিল, এবার তারা ৪০০ এমপি নিয়ে সরকার গঠন করবে। আর তাতেই তেতে উঠেছিল দেশটির শেয়ারবাজার। মূল্যসূচক ওঠেছিল সর্বোচ্চ উচ্চতায়।

কিন্তু প্রথম দুই পর্বের ভোটগ্রহণের পর থেকেই নির্বাচনী হাওয়া বদলে যেতে থাকে। স্পষ্ট হতে থাকে, ৪০০ আসন তো দূরের কথা গতবারের সমান আসন নিয়েও বিজেপি (এনডিএ) ক্ষমতায় আসতে পারবে কি-না তা অনিশ্চিত। তৃতীয় দফা ভোট শেষে উল্টো ইন্ডিয়া জোটের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনার ঝিলিক দেখা দিতে থাকে। আর তখন থেকেই বাজার কিছুটা নিম্নমুখী হতে থাকে।

বিশ্লেষকদের মতে, বিজেপির পরিবর্তে কংগ্রেস জোটের (ইন্ডিয়া) ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের কিছুটা উদ্বিগ্ন করে তুলে। এর পছেনে একাধিক কারণও আছে। প্রথমত: নতুন সরকার ক্ষমতায় এলে বর্তমান বিজেপি সরকারের সব নীতি বহাল রাখবে কি-না তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। বিজেপির বিরুদ্ধে ধনীদেরকে বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া, এক ধরনের অভিজাততন্ত্র কায়েম করার অভিযোগ আছে। অন্যদিকে কংগ্রেস ও তার জোট সঙ্গীরা নির্বাচনে ধনী-গরীবের বৈষম্য কমিয়ে আনার জোরালো প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।

দ্বিতীয়ত: বিনিয়োগকারীসহ দেশটির অনেকেই মনে করেন, ইন্ডিয়া জোট যদি ক্ষমতায় আসেও, কংগ্রেস বড় ধরনের সংখ্যাগরিষ্টতা নিয়ে আসতে পারবে না। তাতে সরকার পরিচালনায় তাদেরকে অন্য দলের উপর অতিমাত্রায় নির্ভর করতে হবে। তাতে প্রশাসনে গতি থাকবে না। অন্যদিকে বিজেপি ক্ষমতায় ফিরলে নিশ্চিতভাবেই নরেন্দ্র মোদি আবার প্রধানমন্ত্রী হবেন। কিন্তু ইন্ডিয়া জোট সংখ্যাগরিষ্টতা পেলে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন তা এখনো স্পষ্ট করা হয়নি। এমন অস্পষ্ট-অনিশ্চিত অবস্থায় অনেক বিনিয়োগকারী সাইডলাইনে অবস্থান নিচ্ছেন। তাতে বাজারে কিছুটা অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।

দ্বিতীয় ধাপের ভোটের পরে নির্বাচনী ফলাফল নিজেদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশংকা দেখা দেওয়ার পর থেকে বিজেপি উগ্র প্রচারণায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানা কথা বলে হিন্দু ভোটারদের ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করছে, ইন্ডিয়া জোট ক্ষমতায় এলে হিন্দুদের সম্পদ কেড়ে নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিলিয়ে দেবে বলে প্রচার করছে।

তাতেও হাওয়া তাদের পক্ষে না আসায় এবার শেয়ারবাজারকে তারা অস্ত্র বানাচ্ছে। বিজেপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ইন্ডিয়িা জোট ক্ষমতায় এলে দেশটির শেয়ারবাজারে ধস নামবে। তাতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ আরও বেড়েছে। বেড়েছে বাজারের অস্থিরতা।

তবে গত এক সপ্তাহে কংগ্রেসের প্রধান মুখপাত্র জয়রাম রমেশসহ একাধিক নেতা অভিযোগ করেছেন, ‘ইন্ডিয়া’ ক্ষমতায় এলে শেয়ার বাজারে ‘ধস নামবে’— এই কথা রটিয়ে বিজেপি আতঙ্ক তৈরির মাধ্যমে নির্বাচনী মাঠে ফায়দা নিতে চাইছে। কংগ্রেসের দাবি, খোদ অমিত শাহ শেয়ার বাজারে লগ্নিকারীদের মধ্যে ‘ইন্ডিয়া’ নিয়ে আতঙ্ক ছড়াতে চাইছেন। আজ কংগ্রেসের প্রধান মুখপাত্র জয়রাম রমেশ দাবি করেছেন, আর্থিক বৃদ্ধি ও সকলের জন্য উন্নয়নের মাপকাঠিতে অতীতের কংগ্রেস সরকারের ‘ট্র্যাক রেকর্ড’ অনেক ভাল।

আজ জয়রাম পাল্টা বলেছেন, অমিত শাহ আতঙ্ক তৈরি করতে চাইছেন, যার কোনও ভিত্তি নেই। মনমোহন সরকারের আমলে মোদী সরকারের তুলনায় আর্থিক বৃদ্ধি, লগ্নি, কারখানার উৎপাদনের হার অনেক বেশি ছিল। মোদী সরকার নোট বাতিল, জিএসটি, অপরিকল্পিত লকডাউন করে অনিশ্চয়তা, আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছে। তার সঙ্গে কর সন্ত্রাস, তদন্তকারী সংস্থার ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায় করা যোগ হয়েছে।

কংগ্রেস নেতা শশী তারুরের বক্তব্য, কংগ্রেসের ইস্তাহার কমিটিতে আর্থিক বৃদ্ধি ও সামাজিক ন্যায়, দুইয়ের প্রতি কংগ্রেসের দায়বদ্ধতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। মোদী সরকারের ‘কর-সন্ত্রাস’ আসলে শিল্পমহলকে দেশ থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে বলে তাঁর দাবি। আনন্দবাজার ও বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড অবলম্বনে