দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দেশের পুঁজিবাজার নিয়ে একের পর গুজব সৃষ্টি করে দরপতন ঘটিয়ে যাচ্ছে কারসাজি চক্র একটি চক্র। মুলত বাজেটকে সামনে রেখে চক্রটি নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে বাজারকে অস্থিতিশীল করছে। সর্বশেষ গেইন ট্যাক্স বা মূলধনী মুনাফার ওপর করারোপ ইস্যু দেখিয়ে সক্রিয় হয়েছে কারসাজি চক্র।

জানা গেছে, কারসাজি চক্র বিভিন্ন সময় নানা নেতিবাচক খবরের অজুহাতে বাজারে পতন ঘটায়। অথচ দেশের কোনো ভালো খবরে পুঁজিবাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে না। শুধু নেতিবাচক খবরেই বাজারে দপরতন হয়। বিষয়টি নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসএসি) বিব্রত।

এছাড়া বিগত কয়েক বছর ধরে পুঁজিবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা মুনাফা করতে পারছে না। এ অবস্থায় গেইন ট্যাক্সের নামে বাজারকে অস্থিতিশীল করাই মূল উদ্দেশ্য। বিষয়টি নিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোনো আগ্রহ নেই। কারণ বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘদিন ধরে লোকসানে রয়েছেন।

জানা গেছে, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ৪০ লাখ টাকার বেশি মুনাফার ওপর কর আরোপের কথা ভাবছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংস্থাটি আগামী (২০২৪-২৫) অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। সেক্ষেত্রে করের হার হতে পারে ১৫ শতাংশ। মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শেই এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। এ খবরে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের পুঁজিবাজারে। যদিও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেছেন, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ওপর গেইন ট্যাক্স আরোপ করা হচ্ছে না। এরপরও এ নিয়ে বাজারে পেনিক সৃষ্টি করছে একটি মহল।

একের পর এক ইস্যু সৃষ্টি করে বাজারে দরপতন ঘটিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে ডিএসইর সূচক ৬ হাজার ২০০ থেকে ৬ হাজার ৪০০ এর মধ্যে ওঠানামা করছিল। এরপর জাতীয় নির্বাচনের পর সূচক ইতিবাচক ধারায় ফিরছিল। ২১ জানুয়ারি ৩৫ কোম্পানি বাদে সবগুলোর ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়া হয়। ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়ার পর সূচক ৬ হাজার ৩৪৬ থেকে এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৬ হাজার ৭৯ পয়েন্টে নেমে আসে। এরপর আবারও বাজার ইতিবাচক ধারায় ফিরে। সূচক আবারও ৬ হাজার ৪৪৭ পয়েন্টে ওঠে।

এরপর গত ফেব্রম্নয়ারিতে প্রথম লভ্যাংশ না দেওয়া কয়েকটি কোম্পানিকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করার ঘোষণা দেওয়ার পর ঢালাও দরপতন শুরু হয়। বাজার আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। বর্তমানে সূচক ৫ হাজার ৩৭১ পয়েন্টে অবস্থান করছে। ১১ ফেব্রম্নয়ারি থেকে দরপতন চলছে। একদিন সূচক বাড়লে চার দিন সূচক কমে। ২০২১ সালের ১০ অক্টোবর ডিএসইর প্রধান সূচক ছিল ৭ হাজার ৩৬৭ পয়েন্ট। তিন বছর ৭ মাস ৯ দিন পর ২১ মে ডিএসইর সূচক কমে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৩৭১ পয়েন্টে। এই সময়ের মধ্যে সূচক কমে গেছে ১ হাজার ৯৯৬ পয়েন্ট।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আলোচ্য সময়ে শেয়ারবাজারে ১৫টির বেশি নতুন কোম্পানির শেয়ার তালিকাভুক্ত হয়েছে। এসব কোম্পানির শেয়ার সূচকে যোগ হয়েছে। যদি কোম্পানিগুলোর শেয়ার সূচক থেকে বাদ দেওয়া হয়, তাহলে ডিএসইর সূচকের পতন দাঁড়াতে পারে ২ হাজার ২০০-এর বেশি।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে ডিএসইর প্রধান সূচক ছিল ৫ হাজার ৬৯৬। সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস মঙ্গলবার লেনদেন শেষে কমে দাঁড়ায় ৫ হাজার ৩৭১ পয়েন্টে। চলতি সপ্তাহের তিন কর্মদিবসেই সূচক কমেছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও নানা কারণে সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা বিরাজ করছে। তারপরও প্রায় সব দেশের শেয়ার মার্কেট রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের শেয়ারবাজারও রেকর্ড উচ্চতায় অবস্থান করছে। এমনকি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে থাকা শ্রীলংকার শেয়ার মার্কেটও ইতোমধ্যে অনেক দূর এগিয়েছে। কিন্তু ব্যতিক্রম বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেট। এখানে সব খাতেই কমবেশি উত্থান হয়েছে। কিন্তু শেয়ার মার্কেট আরও পেছনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। দেশের বিনিয়োগকারীরা এমন সময়ে শেয়ারের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন যখন অন্যান্য দেশের শেয়ারবাজার চাঙা হচ্ছে। যদিও ইউক্রেন যুদ্ধ এখনো চলছে। মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে সংঘাত শুরু হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত ৩০টি বড় প্রতিষ্ঠানের সূচক গত শুক্রবার প্রথমবারের মতো ৪০ হাজার পয়েন্ট হয়। গত মার্চে সংকটে থাকা অর্থনীতির মধ্যে জার্মানির বেঞ্চমার্ক বস্নু-চিপ স্টক ইনডেক্স প্রথমবারের মতো ১৮ হাজার পয়েন্টে পৌঁছায়। বাহ্যিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নিফটি ৫০ ও ভারতের বিএসই সেনসেক্স রেকর্ড করেছে। ২০২৩ সালকে ২০১৭ সালের পর দ্বিতীয় সেরা বছর হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। গত সপ্তাহে পাকিস্তানের বেঞ্চমার্ক সূচক ৭১ হাজার ৪৭৪ পয়েন্টের রেকর্ড উচ্চতায় লেনদেন করে। গত এক বছরে পাকিস্তানের বাজার ৭৪ শতাংশ বেড়েছে। এর বাইরেও ঘন ঘন নীতির পরিবর্তনে পুঁজিবাজারের প্রতি আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। ফোর্স সেলও চরমভাবে ক্ষতি করছে পুঁজিবাজারকে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং ও ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন বলেন, গেইন ট্যাক্স নিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। এটি কারসাজি চক্রের কাজ। তারা গেইন ট্যাক্সের গুজব সৃষ্টি করে বাজারকে অস্থিতিশীল করছে। এ চক্রটি পুঁজিবাজারকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বের করে দিতে চায়। সব শেয়ার কম মূল্যে হাতিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা করছে। যদি সাধারণ বিনিয়োগকারী বাজারেই না থাকে, তাহলে পুঁজিবাজার চলবে কী করে এমন প্রশ্নও রাখেন তিনি।

ডিএসইর সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি আহমেদ রশীদ লালী বলেন, ১৫ দিন ধরে বাজারে এক ধরনের প্রচারণা চলছে গেইন ট্যাক্স আসছে। পলিসি শিফট, ইন্টারভেনশন, মার্জিন রুল এসব যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণ বাজারের গতি ফিরে পেতে বিশাল সমস্যা হবে।

মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সাবেক সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, সব পলিসি অনেক বেশি পরিবর্তন হচ্ছে। এছাড়া ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়েও যে নেতিবাচক প্রচারণা, তা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের প্রভাব ফেলছে। ইতিবাচক পলিসি ছাড়া পুঁজিবাজারকে দাঁড় করানো কঠিন। যদিও সব পক্ষই বলছেন, এমনিতেই চরম সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের পুঁজিবাজারে। এমন অবস্থায় মূলধনী মুনাফা ওপর কর আরোপ করা হলে বাজারে বিনিয়োগকারী আরও কমবে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।