দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: নানা সংকটের মধ্যেও দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা বেড়েছে। ভালো ব্যবসা করার কারণে বছর শেষে এসব প্রতিষ্ঠানের মুনাফায়ও উল্লম্ফন হয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই ২০২৩ হিসাব বছরের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সমন্বিত নিট মুনাফা বেড়েছে ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে ১৩টি বহুজাতিক কোম্পানি। এর মধ্যে ৯টি কোম্পানি ২০২৩ সালের আর্থিক হিসাব প্রকাশ করেছে। এসব বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, বছর শেষে কোম্পানিগুলোর সমন্বিত নিট মুনাফা হয়েছে ৬ হাজার ৩৪৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। এক বছর আগে এসব প্রতিষ্ঠানের নিট মুনাফা হয়েছিল ৫ হাজার ৬১৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে এসব প্রতিষ্ঠানের নিট মুনাফা বেড়েছে ৭৩২ কোটি ৯ লাখ টাকা বা ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ।

তথ্যানুসারে, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ, গ্রামীণফোন, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট বাংলাদেশ, লিন্ডে বাংলাদেশ, ম্যারিকো বাংলাদেশ, আরএকে বাংলাদেশ, রেকিট বেনকিজার বাংলাদেশ পিএলসি, সিঙ্গার বাংলাদেশ, ইউনিলিভার কনজ্যুমার কেয়ার লিমিটেড, রবি, বাটা সু এবং লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশ লিমিটেড। এর মধ্যে বার্জার ও ম্যারিকোর বছর শেষের হিসাব করা হয় মার্চ শেষে। আর লিন্ডে বিডি ও বাটা শু ২০২৩ সালের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোনের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, বহুজাতিক কোম্পানিটি ২০২৩ হিসাব বছর শেষে সবচেয়ে বেশি মুনাফা করেছে। বছর শেষে কোম্পানিটির নিট মুনাফা হয়েছে ৩ হাজার ৩০৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। আগের হিসাব বছরে কোম্পানিটি মুনাফা করেছিল ৩ হাজার ৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা।

এ হিসাবে বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির নিট মুনাফা বেড়েছে ২৯৮ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এ সময় কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ২৪ টাকা ৪৯ পয়সা। আগের বছরে শেয়ারপ্রতি আয় ছিল ২২ টাকা ২৯ পয়সা। এ হিসাবে বছরের ব্যবধানে গ্রামীণফোনের শেয়ারপ্রতি আয় বেড়েছে ৯ দশমিক ৯১ শতাংশ। কোম্পানিটি সমাপ্ত হিসাব বছরে বিনিয়োগকারীদের জন্য ১২৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে।

বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান লাফার্জহোলসিম। নিট মুনাফার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সিমেন্ট খাতের কোম্পানি লাফার্জ হোলসিম। ২০২৩ হিসাব বছর শেষে কোম্পানিটির নিট মুনাফা হয়েছে ৫৯৪ কাছি ১৪ স্থাক টাকা। আগের হিসাব বছরে কোম্পানিটির নিট মুনাফা হয়েছিল ৪৪৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এ হিসাবে বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির নিট মুনাফা বেড়েছে ১৪৯ কোটি ৭২ লাখ টাকা বা ৩৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ।

এ সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে ৫ টাকা ১২ পয়সা। আগের বছর শেয়ারপ্রতি আয় ছিল ৩ টাকা ৮৩ পয়সা। এ হিসাবে বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় বেড়েছে ৩৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ। কোম্পানিটি সমাপ্ত হিসাব বছরে বিনিয়োগকারীদের জন্য ৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। টেলিযোগাযোগ খাতের আরেক কোম্পানি রবি আজিয়াটা লিমিটেডের মুনাফা বেড়েছে।

২০২৩ হিসাব বছর শেষে কোম্পানিটির নিট মুনাফা হয়েছে ৩২০ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। আগের হিসাব বছরে কোম্পানিটির নিট মুনাফা হয়েছিল ১৮২ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এ হিসাবে বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির নিট মুনাফা বেড়েছে ১৩৮ কোটি ২৪ লাখ টাকা বা ৭৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এ সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে ৬১ পয়সা। আগের বছর শেয়ারপ্রতি আয় ছিল ৩৫ পয়সা। এ হিসাবে বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় বেড়েছে ৭৪ দশমিক ২৯ শতাংশ। কোম্পানিটি সমাপ্ত হিসাব বছরে বিনিয়োগকারীদের জন্য ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। সিমেন্ট খাতের আরেক কোম্পানি

হাইডেলবার্গের সমাপ্ত বছরে নিট মুনাফা বেড়েছে। ২০২৩ হিসাব বছর শেষে কোম্পানিটির নিট মুনাফা হয়েছে ৪৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। আগের হিসাব বছরে কোম্পানিটির নিট লোকসান হয়েছিল ২৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এ হিসাবে বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির নিট মুনাফা বেড়েছে ৬৯ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এ সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে ৮ টাকা ১৩ পয়সা। আগের বছর শেয়ারপ্রতি স্প্যান ছিল ৪ টাকা ১৩ পয়সা।

কোম্পানিটি সমাপ্ত হিসাব বছরে বিনিয়োগকারীদের জন্য ২৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। প্রকৌশল খাতের কোম্পানি সিঙ্গার বাংলাদেশের নিট মুনাফা বেড়েছে। ২০২৩ হিসাব বছর শেষে কোম্পানিটির নিট মুনাফা হয়েছে ৫২ কোটি ২১ লাখ টাকা। আগের হিসাব বছরে কোম্পানিটির নিট মুনাফা হয়েছিল ৭ কোটি ৩১ লাখ টাকা।

এ হিসাবে বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির নিট মুনাফা বেড়েছে ৪৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা বা ৬১৪ দশমিক ২৩ শতাংশ। এ সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে ৫ টাকা ২৪ পয়সা। আগের বছর শেয়ারপ্রতি আয় ছিল ৭৩ পয়সা। এ হিসাবে বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় বেড়েছে ৬১৭ দশমিক ৮১ শতাংশ। কোম্পানিটি সমাপ্ত হিসাব বছরে বিনিয়োগকারীদের জন্য ৩৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে।

খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের কোম্পানি ইউনিলিভার কনজ্যুমার কেয়ার লিমিটেডের নিট মুনাফা বেড়েছে। ২০২৩ হিসাব বছর শেষে কোম্পানিটির নিট মুনাফা হয়েছে ৯৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা। আগের হিসাব বছরে। কোম্পানিটির নিট মুনাফা হয়েছিল ৭৩ কোটি ৪ লাখ টাকা। এ হিসাবে বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির নিট মুনাফা বেড়েছে ২৩ কোটি ১২ লাখ টাকা বা ৩১ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

এ সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে ৪৯ টাকা ৮৯ পয়সা। আগের বছর শেয়ারপ্রতি আয় ছিল ৩৭ টাকা ৯০ পয়সা। এ হিসাবে বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় বেড়েছে ৩৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ। কোম্পানিটি সমাপ্ত হিসাব বছরে বিনিয়োগকারীদের জন্য ৩০০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। বেনকিজার বাংলাদেশের নিট মুনাফা বেড়েছে।

২০২৩ হিসাব বছর শেষে কোম্পানিটির নিট মুনাফা হয়েছে ৮২ কোটি ৫ লাখ টাকা। আগের হিসাব বছরে কোম্পানিটির নিট মুনাফা হয়েছিল ৬৫ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এ হিসাবে বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির নিট মুনাফা বেড়েছে ১৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা বা ২৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এ সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে ১৭৩ টাকা ৬৫ পয়সা। আগের বছর শেয়ারপ্রতি আয় ছিল ১৩৯ টাকা ৫০ পয়সা। এ হিসাবে বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় বেড়েছে ২৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ।

কোম্পানিটি সমাপ্ত হিসাব বছরে বিনিয়োগকারীদের জন্য ৫৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশের নিট বেড়েছে। ২০২৩ হিসাব বছর শেষে কোম্পানিটির নিট মুনাফা হয়েছে ১ হাজার ৭৮৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। আগের হিসাব বছরে কোম্পানিটির নিট মুনাফা হয়েছিল ১ হাজার ৭৮৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। এ হিসাবে বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির নিট মুনাফা বেড়েছে ৬৭ লাখ টাকা বা শূন্য দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। এ সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে ৩৩ টাকা ১১ পয়সা। আগের বছর শেয়ারপ্রতি আয় ছিল ৩৩ টাকা ১০ পয়সা।

কোম্পানিটি সমাপ্ত হিসাব বছরে বিনিয়োগকারীদের জন্য ১০০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। সিরামিকস খাতের কোম্পানি আরএকে সিরামিকস বাংলাদেশের নিট মুনাফা কমেছে। ২০২৩ হিসাব বছর শেষে কোম্পানিটির নিট মুনাফা হয়েছে ৬০ কোটি ৮২ লাখ টাকা। আগের হিসাব বছরে কোম্পানিটির নিট মুনাফা হয়েছিল ৬৯ কোটি ১৩ লাখ টাকা।

এ হিসাবে বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির নিট মুনাফা কমেছে ৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা বা ১২ দশমিক ২ শতাংশ। এ সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে ১ টাকা ৪২ পয়সা। আগের বছর শেয়ারপ্রতি আয় ছিল ১ টাকা ৬২ পয়সা। এ হিসাবে বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় কমেছে ১২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। কোম্পানিটি সমাপ্ত হিসাব বছরে বিনিয়োগকারীদের জন্য ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে।

বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ভালো মুনাফা করার ব্যাপারে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বিদেশি কোম্পানিগুলো এ রকম আয় করে থাকে। কারণ বিদেশি কোম্পানিগুলোর স্বচ্ছতা রয়েছে, সঠিক তথ্য দেয়, সঠিকভাবে পরিচালনা করে। আর দেশি কোম্পানিগুলোর বেশির ভাগ ফ্রড। এরা মিথ্যা তথ্য দেয়, কারচুপি করে। বিদেশি কোম্পানিগুলো এসব করে না। তারা ব্যবসা করে বিনিয়োগকারীদের দেয় এবং নিজেরা টাকা নিয়ে যায়।