পুঁজিবাজারের পতন ঠেকাতে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দসহ বিনিয়োগকারীদের ১২ দাবি
দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে শেয়ার বিক্রি করে অর্জিত মূলধনি মুনাফায় (ক্যাপিটাল গেইন) করারোপ না করার আহ্বান জানিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। আজ বুধবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানিয়েছে পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী জাতীয় ঐক্য ফাউন্ডেশন (ক্যাপমিনাফ)। এ ছাড়া পুঁজিবাজারের জন্য ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ৫০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা, নতুন কোম্পানির তালিকাভুক্তি বন্ধ রাখা ও বাইব্যাক আইন কার্যকর করাসহ ১২ দফা দাবি তুলে ধরেন সংগঠনটির সভাপতি রুহুল আমিন আকন্দ।
ক্যাপমিনাফ সভাপতি বলেন, আগামী বাজেটে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীর ওপর ক্যাপিটাল গেইনে ট্যাক্স আরোপ হতে যাচ্ছে, এমন একটি নিউজ দেশের সকল জাতীয় পত্রিকায় এসেছে। যদি এই মুহূর্তে গেইন ট্যাক্স আরোপ করা হয়, তবে পুঁজিবাজার দীর্ঘমেয়াদের জন্য আকর্ষণ হারাবে। বর্তমানে অনেক বিনিয়োগকারীর অপ্রদর্শিত অর্থ রয়েছে পুঁজিবাজারে।
শুধু তাই নয় পুঁজিবাজার নিচে চলে আসায় অনেক অপ্রদর্শিত অর্থ পুঁজিবাজারে ঢোকার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই অবস্থায় যদি ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের ওপর গেইন ট্যাক্স আরোপ করা হয়, তবে ঐ টাকাগুলো হয়তো আর বাজারে আসবে না, যা পুঁজিবাজারকে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য মন্দা অবস্থার দিকে ঠেলে দেবে।
রুহুল আমিন আকন্দ বলেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে সরকারকে। কলসির নিচে যদি ফুটা থাকে, তাহলে পানি যতই ঢালেন, কলসি ভরবে না। কলসের ফুটা বন্ধ করতে হবে। তেমনি পুঁজিবাজারের টাকা বের হয়ে যাওয়ার ছিদ্রগুলো বন্ধ করতে হবে। তবেই বাজার দীর্ঘমেয়াদে ভালো হবে।
তিনি বলেন, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার বর্তমান পর্ষদ দায়িত্ব নেওয়ার পর তাদের নানা আশ্বাস ও আহ্বানে নতুন করে অনেক বিনিয়োগকারী তাদের পুঁজি বাজারে বিনিয়োগ করেছেন। কিন্তু অপরিপক্কতা ও দূরদর্শীতার অভাব, কিছু বিতর্কিত গোষ্ঠির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া, বস্তা পঁচা কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির অনুমোদন দিয়ে বাজার থেকে বেহিসাবি (বিশাল আকারের) অর্থ বের করে নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেয়াসহ বিভিন্ন কারণে দীর্ঘদিন ধরে পুঁজিবাজারে অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছে। এ অবস্থায় আমরা বিনিয়োগকারীরা খুব অসহায় অবস্থায় রয়েছি।
দেশের পুঁজিবাজার স্মরণকালের খারাপ সময় অতিবাহিত করছে বলে মনে করে ক্যাপমিনাফ। রুহুল আমিন আকন্দ বলেন, দীর্ঘ ১৫ বছর পুঁজিবাজারে যে অনিয়ম হয়েছে তারই ফলাফল এখন ভোগ করছে দেশের সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এর পেছনে রয়েছে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর স্বেচ্ছাচারিতা, নিয়ন্ত্রণ সংস্থার অব্যবস্থাপনা, বন্ধ কোম্পানির ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করা, সিন্ডিকেট করে প্লেসমেন্ট বাণ্যিজ্যের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া,
বন্ধ কোম্পানির পরিচালকরা ভুয়া এবং আকর্ষণীয় মিথ্যা তথ্য দিয়ে তাদের শেয়ারগুলো সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ধরিয়ে দিয়ে বাজার থেকে টাকা নিয়ে সটকে পড়াসহ নানা অনিয়ম এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বাজার থেকে সরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। গত কয়েক মাসে প্রায় ৭০ হাজার বিও একাউন্ট থেকে সমস্ত শেয়ার বিক্রি করে বিও একাউন্ট খালি করে দিয়েছে বিনিয়োগকারীরা।
অভ্যন্তরীণ সমস্যার পাশাপাশি পুঁজিবাজারে বর্তমানে যোগ হয়েছে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক চাপ। এ বিষয়ে ক্যাপমিনাফ সভাপতি রুহুল আমিন আকন্দ বলেন, গত ২ বছরে দেশের ডলারের দাম বেড়ে গেছে ৪০ শতাংশের ওপর। ব্যাংক গুলোতে বর্তমানে তারল্য সংকট প্রকট। কলমানি রেট কোনোভাবেই কমছে না। হু হু করে বাড়ছে ব্যাংকের ইন্টারেস্ট রেট। মুনাফা বেশি পাওয়া যাচ্ছে ট্রেজারি বিল-বন্ডে।
দুই বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডে এখন সর্বোচ্চ সুদ। প্রতিদিন পুঁজিবাজারে লেনদেন ও সূচক কমছে আর বিনিয়োগকারীদের রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বাজারের এই ডাউন ট্রেন্ড শুরু হয়েছে ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে, যা বর্তমানে আরও বেশি ত্বরান্বিত হয়েছে। পতনের ধারা থামিয়ে শেয়ারবাজারকে স্থিতিশীল করা সম্ভব বলে মনে করেন রুহুল আমিন আকন্দ। তিনি বলেন, বর্তমান পুঁজিবাজারের মন্দা পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনায় ১২ দফা দাবি উত্থাপন করছি।
তিনি বলেন, আসন্ন বাজেটে পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতায় ৫০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দের ব্যবস্থা করতে হবে। আগামী এক বছর সব ধরনের আইপিও অনুমোদন বন্ধ রাখতে হবে। টেকনো ড্রাগস লিমিটেডের আইপিও দ্রুত বন্ধ করতে হবে। ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স আরোপ বন্ধ করতে হবে। বাইব্যাক আইন কার্যকর করতে হবে।শেয়ার দর বৃদ্ধি পেলে যেমন কারণ দর্শানো হয়, তেমনি কমলেও যেন এর কারণ দর্শানোর নোটিশের ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তনের ইস্যু দেখিয়ে যেসব কোম্পানির শেয়ার দর আকাশচুম্বী করা হয়েছে, সে সকল কোম্পানির শেয়ার কারসাজি চক্রের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মিউচুয়াল ফান্ড উন্নয়নে দৃশ্যমান কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং আর্থিক সক্ষমতা থাকা সত্বেও নো ডিভিডেন্ড দেয়া কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বিনিয়োগকারী জাতীয় ঐক্য ফাউন্ডেশনের নেতা রুহুল বলেন, ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড বাজার উন্নয়নে ব্যবহার করতে হবে। পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারীদের পুঁজির নিরাপত্তা ও সুরক্ষা তহবিল গঠন করতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশে স্মার্ট পুঁজিবাজার ও স্বচ্ছ্বতা আনয়নে বিএসইসিতে বিনিয়োগকারীদের প্রতিনিধি রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ সম্পূর্ণ নিঃশর্তভাবে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে ক্যাপমিনাফের উপদেষ্টা আলী জামান ও সাধারণ সম্পাদক আছাহাব মিয়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।