পুঁজিবাজারে টানা দরপতনে সর্বশান্ত হচ্ছেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা
মনিরুজ্জামান মনির ও মিজানুর রহমান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দীর্ঘদিন ধরেই বেহাল দশা দেশের পুঁজিবাজারে। মাঝে কিছুদিন ঘুরে দাঁড়ালেও ফের টানা দরপতন চলছে পুঁজিবাজারে। গত ১০ কার্যদিবস ধরে একটানা দরপতন হলেও বাজার নিয়ে মুখ খুলছেন না নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এতে বিনিয়োগকারীরা প্রতিনিয়ত বিনিয়োগ করা পুঁজি হারাচ্ছেন। পুঁজিবাজারের পতন ঠেকানোর কোনো উপায় যেন মিলছে না। বরং দিন যত যাচ্ছে বিনিয়োগ করা পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। সর্বশান্ত হয়ে বাজারবিমুখ হয়ে পড়ছেন হাজার হাজার বিনিয়োগকারীরা।
মুলত প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না পুঁজিবাজার। প্রশ্ন হলো প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরও কেন বাজার ঘুরছে না? বাজার কী তা হলে অদৃশ্য শক্তির হাতে জিম্মি। ঐ চক্রটি গত এক বছর ধরে নানা গুজব ছড়িয়ে বাজারকে অস্থির করছে। পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির চাপে অস্থির হয়ে পড়ছে পুঁজিবাজার। মুলত বাজেটকে সামনে রেখে চক্রটি নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে বাজারকে অস্থিতিশীল করছে। সর্বশেষ গেইন ট্যাক্স বা মূলধনী মুনাফার ওপর করারোপ ইস্যু দেখিয়ে সক্রিয় হয়েছে কারসাজি চক্র।
তবে গত শনিবার টানা দরপতনের কারণ জানতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুঁজিবাজারের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন। তাঁদের কাছে তিনি পুঁজিবাজারের ধারাবাহিক পতনের কারণ জানতে চান। এরপর পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা ফেরাতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের জন্য তিনি নির্দেশনা প্রদান করেন। কিন্তু এরপরও চলছে টানা দরপতন।
জানা গেছে, কারসাজি চক্র বিভিন্ন সময় নানা নেতিবাচক খবরের অজুহাতে বাজারে পতন ঘটায়। অথচ দেশের কোনো ভালো খবরে পুঁজিবাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে না। শুধু নেতিবাচক খবরেই বাজারে দপরতন হয়। বিষয়টি নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি) বিব্রত।
এবিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট চলছে। এর সঙ্গে অর্থনৈতিক বিভিন্ন সংকট, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং গেইন ট্যাক্স বা মূলধনী মুনাফার ওপর করারোপ ইস্যু সর্বশেষ যোগ হয়েছে। ফলে সবার আগে আস্থার সংকট দূর করতে পদক্ষেপ নিতে হবে।
এক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আস্থা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদের এই নিশ্চয়তা দিতে হবে, কারসাজির মাধ্যমে কেউ তার টাকা হাতিয়ে নিলে বিচার হবে। পাশাপাশি ভালো শেয়ারের সরবরাহ বাড়াতে হবে। এ দুই পদক্ষেপের মাধ্যমে বাজারের সমস্যা দূর করা সম্ভব।
আইসিবি সিকিউরিটিজ ট্রেডিংয়ের বিনিয়োগকারী বশির উদ্দিন বলেন, পুঁজিবাজারে দিন যতই যাচ্ছে লোকসানের পাল্লা ততো ভারী হচ্ছে। জানি না এই অবস্থা থেকে কবে মুক্তি পাবো। গত এক বছরে পুঁজিবাজারে ৭০ লাখ টাকার বেশি লোকসান রয়েছি। এখন শেয়ার বিক্রি করতে পারছি না। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। এ অবস্থায় পুঁজিবাজারের ভবিষ্যত নিয়ে দু:চিন্তায় রয়েছি কবে লোকসান কাটিয়ে উঠবো।
মশিউর সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী আজিজুর রহমান বলেন, ৬ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে ৪ লাখ টাকার ওপরে লোকসানে রয়েছি। প্রতিদিন আশায় থাকি বাজার ভালো হবে কবে। কিন্তু কিছুতেই বাজার ভালো হচ্ছে না। দিন যত যাচ্ছে, বাজার তত খাদের মধ্যে চলে যাচ্ছে। লোকসানের চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারি না। এ অবস্থায় আর কতদিন চলবে।
জানা গেছে, পাঁচ বছর আগে ২০১৯ সালের ২৯ এপ্রিল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) প্রধান সূচক ছিল ৫ হাজার ১৭৫ পয়েন্ট। পাঁচ বছর ১ মাস পর আজ ২৯ মে তারিখে ডিএসইর সূচক দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ২২৮ পয়েন্টে। এই ৫ বছর ১ মাসে পুঁজিবাজারে অভিহিত মূল্যে ২৮টি কোম্পানি এবং বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ১১টি কোম্পানি ডিএসইতে তালিকাভুক্ত হয়েছে। যেগুলোর বাজার মূলধন ডিএসইর প্রধান সূচকে যোগ হয়েছে। নতুন এসব শেয়ারের বাজার মূলধন বাদ দিলে ডিএসইর প্রধান সূচক ৪ হাজার ৮০০-এর নিচে হবে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে, আজ ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে চলতি বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন লেনদেন। চলতি বছরের মধ্যে ৩ জানুয়ারি ডিএসইতে লেনদেন হয়েছিল ২৯২ কোটি ১৪ লাখ টাকা। আর সপ্তাহের চতুর্থ কার্যদিবসে লেনদেন হয়েছে ৩০৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। সপ্তাহের চতুর্থ কার্যদিবসে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ডিএসই’র প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫০.৩৫ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৫ হাজার ২২৮ পয়েন্টে। অন্য দুই সূচকের মধ্যে ডিএসই শরীয়াহ সূচক ১৩.৫৯ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ১৩৮ পয়েন্টে এবং ডিএসই-৩০ সূচক ১৬.৭৯ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ৮৬৯ পয়েন্টে।
আজ ডিএসইতে ৩০৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। আগের কর্মদিবসে লেনদেন হয়েছিল ৪৪০ কোটি ৭২ লাখ টাকার। আজ ডিএসইতে ৩৯৪টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দর বেড়েছে ৬৪টির, কমেছে ৩৮৬টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ৪৪টির।
অপর পুঁজিবাজার চট্রগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএই) আজ লেনদেন হয়েছে ১৭০ কোটি ৪ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট। এদিন সিএসইতে ২২২টি প্রতিষ্ঠান লেনদেনে অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে দর বেড়েছে ৩৭টির, কমেছে ১৬৭টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ১৮টি প্রতিষ্ঠানের। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ২৪৩টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট। এরমধ্যে দাম বেড়েছিল ৭৯টির, কমেছিল ১৩৩র এবং অপরিবর্তিত ছিল ৩১টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট।