পুঁজিবাজারে আস্থা ফেরাতে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার পদক্ষেপ জরুরী
দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: অর্থনীতির শক্ত ভিত গড়ে তুলতে পুঁজিবাজারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে পুঁজিবাজার প্রায়ই অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। ফলে বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারান এবং পুঁজিবাজার কাঙ্খিত ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়। কয়েক বছর ধরে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারেও। সে ধারাবাহিকতায় চলতি বছর পুঁজিবাজারের সূচক তেমন বাড়েনি।
ফ্লোর প্রাইস, সুদহার বৃদ্ধি, টাকার অবমূল্যায়ন, ডলারের বিনিময় হারের অস্থিরতা, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর আয় কমে যাওয়া ও বিদেশী শেয়ার বিক্রি, গেইন টেক্স মতো বিভিন্ন ইস্যুতে দীর্ঘদিন ধরেই দেশের পুঁজিবাজার অস্থিতিশীল ও নেতিবাচক ধারায় রয়েছে। যে কারণে বিনিয়োগকারীরা প্রত্যাশা অনুযায়ী মুনাফা অর্জন করতে পারেননি। ফলে আস্থা হারিয়ে ফেলছে বিনিয়োগকারীরা।
এদিকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে পুঁজি হারিয়ে বের হয়ে এসেছেন অনেক বিনিয়োগকারী। তথ্য বলছে, পুঁজিবাজারে ২০১৫ সালের জুন মাসের শেষে বিনিয়োগকারী ছিলেন ৩১ লাখ ৯৫ হাজার। পুঁজিবাজারের এই পতনের জন্য বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা ও আতঙ্কিত হওয়া বড় কারণ। টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ কারণে অনেকে হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে বাজার ছাড়ছেন। পুঁজিবাজার থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা আনতে নেই আইনের কঠোর প্রয়োগ। তাই বিনিয়োগকারীদের আস্থা আসেনি। প্রতিবছর বাজেট ঘোষণার সময় পুঁজিবাজার নিয়ে আশার কথা শোনা গেলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
পুঁজিবাজারকে গতিশীল করতে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে যেন ৫০ হাজার টাকার লভ্যাংশের ওপর কর প্রত্যাহার করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সংগঠন থেকে একগুচ্ছ সুপারিশ করা হয়েছে। পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে নতুন নতুন কোম্পানি আনা প্রয়োজন।
তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির করপোরেট কর ব্যবহারের ব্যবধান বাড়ানোর মাধ্যমে সেটি করা সম্ভব। প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর থেকে চাপ কমাতে না পারলে বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। পুঁজিবাজারের লভ্যাংশকে করমুক্ত আয় হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। বড় বা ভালো মানের প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত না হলে পুঁজিবাজারের ওপর আস্থা বাড়বে না। তাই ওই সব প্রতিষ্ঠানের ঋণ, মূলধন বা ব্যবসার আকৃতির ওপর তালিকাভুক্তির একটি কাঠামো নির্ধারণ করা যেতে পারে।
আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত ও বাজেটবিষয়ক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিবেদনে পুঁজিবাজারের গতি বাড়াতে রাজস্ব ছাড়সহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু রাজস্ব আদায় কমে যেতে পারে এমন আশঙ্কা এখন পর্যন্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) খসড়া বাজেট প্রস্তাবে কিছুই অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
পুঁজিবাজারে বিশেষ সুবিধায় অপ্রদর্শিত অর্থ (কালোটাকা) বিনিয়োগের পক্ষে এনবিআর মতামত দিলেও বিপক্ষে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। আর তাই এ পদক্ষেপ আগামী অর্থবছরের বাজেটে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বেশির ভাগ উন্নত দেশে পুঁজিবাজার থেকে অর্থনীতির মূলধারায় যোগ হয় বড় অঙ্কের অর্থ। ওই সব দেশের সরকার পুঁজিবাজার থেকে আপৎকালীন অর্থ নিয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশের চিত্র কিছুটা অন্য রকম। গত এক যুগে হাজার হাজার কোটি টাকার কারসাজি করা হলেও কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। দীর্ঘ সময়েও পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা আসেনি।
বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারবিমুখ হচ্ছেন, এটা রেগুলেটরদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। বিশ্লেষকদের সুপারিশগুলো বিবেচনায় এনে বাজেটে পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করতে হবে। দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করতে কর আদায়ের বিকল্প নেই। পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সরকারকে আরও মনোযোগী হতে হবে। বাজেটের মতো বড় আয়োজনের বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। এক কথায় পুঁজিবাজারের গতি ইতিবাচক ধারায় ফিরিয়ে আনতে পারলে অর্থনীতিতে সফলতা আসবে।
তাছাড়া ২০১০ সালের ধসের পর পুঁজিবাজারের প্রতি মানুষের নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়, যা এখনো অনেকাংশে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এজন্য বিনিয়োগকারীরা ফিরলে পুঁজিবাজারে গতি ফিরবে বলে আশা করা হচ্ছে। এজন্য দরকার প্রয়োজনীয় আইনগত সংস্কার ও উদ্যোগ। পরিশেষে পুঁজিবাজারে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও সুশাসন নিশ্চিত করে বাজার মূলধন বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে এটিই প্রত্যাশা।