দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: টানা দরপতনে পুঁজিবাজারে ধারাবাহিকভাবে কমছে বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা। এদিকে মন্দার কারণে বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার ছাড়ছে। গত মার্চ থেকে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়। অব্যাহত দরপতনে বিনিয়োগকারীরা চরম আতঙ্কে থাকে। বিনিয়োগকৃত অর্থ ফিরে পাওয়া নিয়ে তাদের মধ্যে একটা অস্থিরতা দেখা দেয়। প্রতি দিনই বাজার মূলধন থেকে তারল্য উধাও হয়ে যাচ্ছে।

চলতি (জুন) মাসের ২০ দিনেই বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাব কমেছে ৫০০টির বেশি। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বিদেশিদের বিও হিসাব কমেছে ৮০০টির বেশি। দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা কমার পাশাপাশি স্থানীয় তথা দেশি বিনিয়োগকারীদের সংখ্যাও কমেছে। চলতি (জুন) মাসে পুঁজিবাজারে স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব কমেছে প্রায় আড়াই হাজার। তবে চলতি বছরের ছয় মাসে স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব বেড়েছে ১৫ হাজারের বেশি।

গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দুই লাখ ৪১ হাজার ২১৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা বাজার মূলধন বের হয়ে গেছে। ফলে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রায় ছয় মাসে ব্যালেন্স শূন্য বিও হিসাবের সংখ্যা বেড়েছে এক লাখ এক হাজার ৯৯২টি। পৌনে এক লাখের বেশি বিও হিসাব আর ব্যবহৃত হচ্ছে না। শেয়ার শূন্য বিও বেড়েছে ৯০ হাজারেরও বেশি।

ব্যালেন্স শূন্য বিও হিসাব এখন তিন লাখ ৯৮ হাজার ৮৯৩টি বলে সেন্ট্রাল ডিপজিটরি বাংলাদেশের (সিডিবিএল) হালনাগাদ পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে। অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, তারা মুনাফা দূরের কথা বিনিয়োগ তুলে নেবার জন্য কম লাভেই শেয়ার বিক্রি করে দেয়। ধারবাহিক মন্দাবস্থা, বাজার ঠিক করতে সরকারি উদ্যোগহীনতা ও আস্থাহীনতায় বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার ছেড়েছেন। দেশী বিনিয়োগকারী চলে গেলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাজারে আসবে না।

এ দিকে, গত ছয় মাসে বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, সর্বশেষ তিন মাসে শেয়ার বিক্রির চাপে কাহিল ছিল পুঁজিবাজার। বাজারে বিক্রেতাদের চাপ ছিল গড়ে ৬০ শতাংশের বেশি। আর গত দুই মাসে বিক্রির চাপ গড়ে ৭০ শতাংশের ওপরে ছিল। কোনো কোনো দিন শেয়ার বিক্রির পরিমাণ ঢাকা স্টকে ৩০ কোটির বেশি ছিল। এই শেয়ারগুলো বিক্রির পর অনেকেই বাজার পর্যবেক্ষণ করেছেন। কিন্তু ফিরেননি পুনরায় বাজারে। ফলে সঙ্কট দেখা দিয়েছে তারল্যের। কমেছে বেচাকেনা।

সিডিবিএল’র তথ্য অনুযায়ী, ২০ জুন শেষে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৮৮ হাজার ২৪৪টি, যা মে মাস শেষে ছিল ১৭ লাখ ৯১ হাজার ২২৮টি। এ হিসাবে জুন মাসের ২০ দিনে বিও হিসাব কমেছে ২ হাজার ৯৮৪টি। ২০২৩ সালের শেষদিন ৩১ ডিসেম্বর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব ছিল ১৭ লাখ ৭৩ হাজার ২০৪টি। এ হিসাবে চলতি বছর বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাবে বেড়েছে ১৫ হাজার ৪০টি।

সিডিবিএল’র তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশি বিনিয়োগকারীদের নামে বিও হিসাব আছে ১৭ লাখ ১৬ হাজার ৯৫টি, যা মে মাস শেষে ছিল ১৭ লাখ ১৮ হাজার ৫৮৮টি। অর্থাৎ দেশি বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব কমেছে ২ হাজার ৪৯৩টি। ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর দেশি বিনিয়োগকারীদের নামে বিও হিসাব ছিল ১৭ লাখ ৭৬৫টি। এ হিসাবে দেশি বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব বেড়েছে ১৫ হাজার ৩৩০টি।

অপরদিকে, বর্তমানে বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব আছে ৫৪ হাজার ৫১১টি। মে মাস শেষে এ সংখ্যা ছিল ৫৫ হাজার ৪৫টি। অর্থাৎ চলতি মাসের ২০ দিনে বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব কমেছে ৫৩৪টি। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর শেষে বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের নামে বিও হিসাব ছিল ৫৫ হাজার ৩৪৮টি। এ হিসাবে চলতি বছর বিদেশি ও প্রবাসীদের বিও হিসাব কমেছে ৮৩৭টি।

বর্তমানে শেয়ারবাজারে যে বিনিয়োগকারী আছেন, তার মধ্যে পুরুষ বিনিয়োগকারীদের নামে বিও হিসাব আছে ১৩ লাখ ৩৯ হাজার ৪৬৩টি। মে মাস শেষে এই সংখ্যা ছিল ১৩ লাখ ৪১ হাজার ৪৫৮টি। অর্থাৎ পুরুষ বিনিয়োগকারীদের হিসাব কমেছে ১ হাজার ৯৯৫টি।

অপরদিকে, বর্তমানে নারী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৩১ হাজার ১৪৩টি। মে মাস শেষে এ সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৩২ হাজার ১৭৫টি। এ হিসাবে নারী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব কমেছে ১ হাজার ৩২টি। এদিকে, বর্তমানে কোম্পানি বিও হিসাব রয়েছে ১৭ হাজার ৬৩৮টি। মে মাস শেষে এ সংখ্যা ছিল ১৭ হাজার ৫৯৫টি। সে হিসাবে কোম্পানি বিও হিসাব বেড়েছে ৪৩টি।

বর্তমানে বিনিয়োগকারীদের যে বিও হিসাব আছে তার মধ্যে একক নামে আছে ১২ লাখ ৫৯ হাজার ৪৬৩টি, যা মে মাস শেষে ছিল ১২ লাখ ৬০ হাজার ৪৯৩টি। অর্থাৎ একক নামে বিও হিসাব কমেছে ১ হাজার ৩০টি। বিনিয়োগকারীদের যৌথ নামে বিও হিসাব আছে ৫ লাখ ১১ হাজার ১৪৩টি। মে মাস শেষে যৌথ বিও হিসাব ছিল ৫ লাখ ১৩ হাজার ১৪০টি। অর্থাৎ চলতি মাসের প্রথম ২০ দিনে যৌথ বিও হিসাব কমেছে ১ হাজার ৯৯৭টি।

বাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলছেন, বেশির ভাগ উন্নত দেশে বড় অঙ্কের অর্থ পুঁজিবাজার থেকে অর্থনীতির মূল ধারায় যোগ হয়। ওই সব দেশের সরকার আপৎকালীন অর্থ শেয়ারবাজার থেকে নিয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে উল্টোটা। তিনি বলেন, গত ২০১৫ সালের জুন মাসের শেষে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীর হিসাব বা বিও ছিল ৩১ লাখ ৯৫ হাজারটি।

আস্থাহীনতায় কমতে কমতে বর্তমানে বিও হিসাব ১৭ লাখ ৫৬ হাজারটি। পুঁজিবাজারের এই পতন অবস্থার জন্য বিনিয়োগকারীদের ‘আস্থাহীনতা ও আতঙ্কিত’ হওয়া বড় কারণ। টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ কারণে অনেকে হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে বাজারে ছাড়ছেন। এ বাজারে গতি আনতে সরকারকে বিশেষ মনোযোগী হতে হবে। বাজেটের মতো বড় আয়োজনে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। পুঁজিবাজারে গতি এলে সমগ্র অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে সে ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ দেখতে পাইনি।