ছাগলকান্ডে বেরিয়ে এলো পুঁজিবাজারে মতিউরের নেতৃত্বে প্লেসমেন্ট বানিজ্য!
আলমগীর হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস এক্সাইজ ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট ড. মতিউর রহমান কাস্টমস বিভাগে দুর্নীতির রাজা! মোহাম্মদপুরের বহুল আলোচিত ‘সাদিক অ্যাগ্রো ফার্ম’ থেকে ১৫ লাখ টাকার ছাগল কিনে ভাইরাল হওয়া ১৯ বছর বয়সী তরুণ মুশফিকুর রহমান ইফাতের বাবা ড. মতিউর রহমানের একের পর এক দুর্নীতি, অনিয়ম ও কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচারসহ দুর্দন্ড প্রতাপে ক্ষমতার অপব্যবহারের বহু ঘটনা বেরিয়ে আসছে।
এই ঘটনায় একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা একাধিক কর্মকতা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এনবিআরের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালনকালে কোটি কোটি বিদেশে পাচার করেছেন মতিউর রহমান। নারী কেলেঙ্কারির সাথেও সে জড়িত। এনবিআরের কোন কর্মকর্তার নির্দেশনা তিনি মানতেন না। ফলে ছাগলকাণ্ডে দেশজুড়ে আলোচিত মতিউর রহমান পুঁজিবাজারের এক ‘দুঃসাহসী খলনায়ক’। পুঁজিবাজার নিয়ে এক যুগেরও বেশি সময় চলছে মতিউর রহমানের অবিশ্বাস্য ভেলকি। ধরাকে সরা জ্ঞান করে গাছের খাচ্ছেন, তলারও কুড়াচ্ছেন।
‘গভীর জলের মাছ’ হয়ে পুঁজিবাজারের নানা চোরাপথে হেঁটেছেন মতিউর রহমান। এই যেমন, আইপিওর আগে এক পয়সাও লগ্নি না করে জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া শেয়ার ইস্যু করেন। বাজারে আসার আগেই প্রথমে এ শেয়ারের কিছু অংশ প্রাইভেট প্লেসমেন্ট প্রক্রিয়ায় বিক্রি করে নগদ টাকা লুটে নেন। পরে ওই কোম্পানিকে বাজারে তালিকাভুক্ত করে বাকি শেয়ার বেচে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।
তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে জমা পড়া অভিযোগটি যাচাই করে কমিশন অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতোমধ্যেই দুদকের কর্মকর্তারা মাঠে নেমেছেন।
দুদক সূত্র জানায়, এর আগে মতিউরের বিরুদ্ধে কমিশনে চারবার দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়েছিল। তবে তাঁর তদবিরের চাপে প্রতিবারই তাঁকে ‘ক্লিন সার্টিফিকেট’ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, ওই সব অভিযোগ আর অনুসন্ধান করা হবে না। তবে এবার কমিশন অভিযোগ আমলে নিয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, এবার অভিযোগটি কমিশনের ব্যাংক শাখা থেকে অনুসন্ধান করা হচ্ছে। অনুসন্ধানে মতিউর এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এক-দুই বছর নয়; এক যুগের বেশি সময় এভাবে পুঁজিবাজারে ‘রাজ’ করছেন মতিউর রহমানের সঙ্গীরা। তবে কারসাজির বিষয়ে নিরেট প্রমাণ থাকলেও মতিউরসহ তাঁর দলবলের বিরুদ্ধে বিএসইসি কোনো সময় কঠোর ব্যবস্থা নেয়নি। মুলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিন্যান্স বিভাগে পড়াশোনা করা মতিউর রহমান অনেক কোম্পানির ছায়া পরিচালক। একাধিক ছোট কোম্পানি পুঁজিবাজারে আনার মাধ্যমে বাজার সংশ্লিষ্টদের কাছে ব্যাপক পরিচিত লাভ করেন। পুঁজিবাজার কারসাজিতে জড়িতদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মতিউর প্লেসমেন্ট প্রক্রিয়ায় যেসব কোম্পানির শেয়ার নিয়েছেন, সেগুলো হলো: এক্মি পেসটিসাইডস (৩৮ লাখ শেয়ার), অনিক ট্রিমস (৫৩.১৯ লাখ), অ্যাসোসিয়েটেড অক্সিজেন (১০ লাখ), বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার (৭৫ হাজার), সিএনএটেক্স (১০.৩০ লাখ), ডমিনেজ স্টিল (১৫.৮০ লাখ), ই-জেনারেশন (৫০ হাজার), ফরচুন সুজ (৪৩.১০ লাখ), কাট্টলী টেক্সটাইল (২১ লাখ), ল্যুবরেফ (৮ লাখ), মামুন এগ্রো (৩৭.৮৭ লাখ), এমএল ডাইং (১৬ লাখ), রিং শাইন (১০ লাখ), এসকে ট্রিমস (৯০ লাখ), টেকনো ড্রাগস (১.৫০ লাখ), ওয়েব কোস্টস (১৩.৯৭ লাখ) শেয়ার। প্যাসিফিক ডেনিম এবং সিলভা ফার্মারও কিছু শেয়ার আছে। এর মধ্যে এসকে ট্রিমস কোম্পানি নিজেই গড়েছেন মতিউর।
মতিউর নিজের ও আত্মীয়স্বজনের নামে যে পরিমাণ প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়েছেন, অভিহিত বা প্রকৃত মূল্য হিসাবে এসব শেয়ারের দাম অন্তত অর্ধশত কোটি টাকা। এর দু-একটি বাদে সব কোম্পানি আগেই শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। তালিকাভুক্তির পর প্লেসমেন্ট প্রক্রিয়ায় নেওয়া এসব শেয়ার উচ্চ মূল্যে বিক্রি করে কয়েকশ কোটি টাকা মুনাফা করেছেন মতিউর রহমান।
প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও প্রক্রিয়ায় শেয়ার বিক্রি করে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে অধিকাংশ কোম্পানি ব্যক্তিগত পর্যায়ে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে শেয়ার বিক্রি করে আগেই মূলধন বাড়িয়ে নেয়। এই প্রক্রিয়ায় বিক্রি করা শেয়ার প্রাইভেট প্লেসমেন্ট শেয়ার হিসেবে পরিচিত। সেকেন্ডারি শেয়ারবাজারে শেয়ার কেনাবেচায় লাভ বা ক্ষতি উভয় সম্ভাবনা থাকলেও আইপিওতে আসা শেয়ারের দাম শুরুতেই অনেক গুণ মূল্যে কেনাবেচা হয়। অর্থাৎ, প্লেসমেন্ট শেয়ার কেনা মানেই বিপুল মুনাফা। এ শেয়ার কিনতে অনেক চাহিদা থাকায় সবাই পান না। কেবল সংঘবদ্ধ প্লেসমেন্ট শেয়ার ব্যবসার চক্র ও প্রভাবশালীদের ভাগ্যে এমন শেয়ার জোটে।
তাছাড়া পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিন ধরেই প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়ে অনিয়ম করে আসছেন ছাগল কাণ্ডে বিতর্কিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস এক্সাইজ ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট ড. মতিউর রহমানের নেতৃত্বাধীন চক্র। যারা বিভিন্ন দূর্বল কোম্পানি থেকে প্লেসমেন্ট শেয়ার পাওয়ার চুক্তিতে পুঁজিবাজারে আনেন। এক্ষেত্রে প্লেসমেন্ট শেয়ার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিনা পয়সায় পেয়ে থাকেন মতিউর সিন্ডিকেট। চক্রটির মূল কাজ থাকে সব ম্যানেজ করে কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আনা।
সর্বশেষ মানহীন এশিয়াটিক ল্যাবকে পুঁজিবাজারে আনতে কাজ করে চক্রটি। মতিউর রহমানের নেতৃত্বাধীন এই চক্রের অন্যতম সদস্য হিসেবে রয়েছে: ফরিদ, ইউনুসুর রহমান ও কাজী সাইফুর রহমান। তারা এশিয়াটিকে অনেক টাকার প্লেসমেন্ট বাণিজ্য করেছে।
কিন্তু কোম্পানিটির আইপিও স্থগিত হওয়ায় বিপদে পড়ে গিয়েছিল। এই অবস্থায় কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে খরচ করে কোম্পানিটিকে পুঁজিবাজারে আসার পথ পরিস্কার করতে উদ্যোগ নিয়েছিল তারা। বিএসইসির তদন্ত কমিটি এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের বিষয়ে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়। যেখানে বিভিন্ন অনিয়মের কথা তুলে ধরা হয়। যাতে কোম্পানিটির আইপিওতে আবেদন গ্রহনের ঠিক আগের দিন স্থগিত করা হয়।
কিন্তু এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের চক্রটি বিএসইসির সেই তদন্ত কার্যক্রমও স্থগিত করে দেওয়ার জন্য জোর তৎপর চালিয়েছিল। সেই চক্রটিই পুঁজিবাজারের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে অবৈধ উপায়ে আইপিও বাতিল ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল এবং সফল হয়। এভাবে চক্রটি এসোসিয়েটেড অক্সিজেন, একমি পেস্টিসাইডস, অ্যাগ্রো অর্গানিকার মতো আরো কিছু দূর্বল কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে এনেছে। তবে চক্রটির নিজেদের মধ্যে মনমালিন্য হওয়ায় পুঁজিবাজারে আসতে চাওয়া ইসলাম অক্সিজেনকে ভ্যাট জটিলতায় ফেলে দেন মতিউর রহমান।
গাজীপুরের গ্লোবাল সু ও গ্লোবাল ম্যাক্স প্যাকেজিং কোম্পানিতে মতিউরের দুই সন্তান অর্ণব ও ইপসিতার মালিকানা রয়েছে। আর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেশ কয়েকটি কোম্পানিতে এই দুই প্রতিষ্ঠানের নামে কৌশলে প্লেসমেন্ট শেয়ার নেন মতিউর রহমান। আর গ্লোবাল ম্যাক্সের মালিকানা রয়েছে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানি এসকে ট্রিমস ইন্ডাস্ট্রিজে। মার্চেন্ট ব্যাংক শাহজালাল ইক্যুইটিতেও মালিকানা রয়েছে তার। বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের অনুমোদন পাওয়া এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের স্থায়ী সম্পদ নিয়ে বিভিন্ন অপকর্ম খুঁজে পায় বিএসইসি।
এছাড়া ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলও (এফআরসি) খুঁজে পায় নানা অপকর্ম। কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করতে এতোটাই অনিয়ম করেছে যে, যা কোম্পানিটির প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) বাতিলের জন্য যথেষ্ট ছিল। এই অবস্থায় আইপিও বাতিল ঠেকাতে অবৈধ পথে নেমেছিল এশিয়াটিক কর্তৃপক্ষ ও প্লেসমেন্ট চক্রটি। তারা বিএসইসিকে পক্ষে আনতে নানাভাবে লবিংও করে। অবশেষে সফলতাও পেয়েছেন।
এফআরসির তদন্তে এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের সম্পদ অতিমূল্যায়িতসহ আর্থিক হিসাবে নানা অনিয়ম পাওয়া যায়। কোম্পানি কর্তৃপক্ষ সম্পদ বাড়িয়ে দেখানোর জন্য মিথ্যা তথ্য দিয়েছে। এছাড়া কোম্পানির চলতি সম্পদ, আয়, মুনাফা ও শেয়ার মানি ডিপোজিট নিয়ে অসঙ্গতি পেয়েছে। যা বিএসইসিকে অবহিত করে।
জানা গেছে, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ কর্তৃপক্ষ বুক বিল্ডিংয়ে উচ্চ দর পেতে এবং বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে ভূয়া সম্পত্তি দেখিয়েছে। যা কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের মাধ্যমে নিজেদের শেয়ারধারণও বাড়িয়ে দিয়েছে। এশিয়াটিকের প্রসপেক্টাসে কোটি কোটি টাকার ভূয়া সম্পত্তি দেখানো হয়। বেশি দামে রেজিস্ট্রি, পূণ:মূল্যায়নের মাধ্যমে অতিরঞ্জিত, অস্বাভাবিক জমি উন্নয়ন ব্যয়সহ বিভিন্নভাবে সম্পদ বাড়িয়ে দেখানোর মাধ্যমে এই গুরুতর অনিয়ম করা হয়। যে রিপোর্ট বিএসইসির তদন্ত কমিটি জমা দেয়।
বিদ্যমান পাবলিক ইস্যু রুলস অনুযায়ি, বুক বিল্ডিংয়ে পদ্ধতিতে কাট-অফ প্রাইস নির্ধারণে সরাসরি ভূমিকা রাখে কোম্পানির সম্পদ। আর এই সুযোগ কাজে লাগাতেই ভূয়া সম্পত্তি দেখিয়েছে এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ কর্তৃপক্ষ। যার মাধ্যমে খুবই অপরিচিত এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের ৫০ টাকার মতো কাট-অফ প্রাইস নির্ধারিত হয়। অথচ এই কোম্পানির নাম এবং ওষুধ বাজারে আছে, তা জানেই না মানুষ।
এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের সম্পত্তি নিয়ে প্রতারণার বিষয়টি খুবই গুরুতর বলে জানিয়েছিল বিএসইসির এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। যা কোনভাবেই কোম্পানিটির আইপিও দেওয়ার জন্য উপযুক্ত নয়। বরং প্রতারণার দায়ে কোম্পানি কর্তৃপক্ষসহ ইস্যু ম্যানেজারের নামে মামলা করা উচিত। একইসঙ্গে আর্থিক জরিমানা ও শেয়ারবাজারে আজীবন নিষিদ্ধ করা দরকার। তাহলে অন্যরাও অপকর্ম করা থেকে দূরে সরে আসবে। অন্যথায় এই বাজারকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না।
দুদক সূত্র জানায়, তাঁর বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য রয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন তিনি। বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট, জমি, ব্যবসা, শেয়ার ব্যবসা, ব্যাংকে নগদ অর্থ, মেয়াদি আমানতসহ সবকিছুই আছে তাঁর নামে। মতিউর বর্তমানে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
গত কয়েক দিনে তাঁর ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাতের ১৫ লাখ টাকায় কোরবানির ছাগল, ৭০ লাখ টাকায় কয়েকটি গরু কেনার ছবি ও খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। মতিউর বলেছেন, ইফাত তাঁর ছেলে নয়। পরে জানা গেছে, ইফাত তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর একমাত্র সন্তান।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা, গাজীপুর, সাভার, নরসিংদী, বরিশালসহ বিভিন্ন জায়গায় মতিউরের নামে বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট, প্লটসহ অন্যান্য স্থাবর সম্পদ রয়েছে। তাঁর প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ বর্তমানে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা চেয়ারম্যান। এ দম্পতির মেয়ে ফারজানা রহমান ইস্পিতা ও ছেলে তৌফিকুর রহমান অর্ণবের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা জমা রয়েছে।
জানা গেছে, মতিউর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে, মন্ত্রণালয়ের সচিব ও রাজনৈতিক নেতাদের নাম ভাঙিয়ে অবাধে দুর্নীতি করে আসছেন। সব মিলিয়ে তিনি শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তাঁর নামে-বেনামে ঢাকায় বিভিন্ন ব্যাংকে প্রায় ৪০ কোটি টাকার এফডিআর রয়েছে। দুর্নীতি-সংক্রান্ত ঝামেলা এড়ানোর জন্য স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজনের নামে সম্পদ রেখেছেন তিনি।
দুদক সূত্রে মতিউর রহমানের নামে-বেনামে আরও সম্পদের তথ্য জানা গেছে। বসুন্ধরার ডি ব্লকের ১ নম্বর রোডে পাঁচ কাঠা জমির ওপর সাততলা বাড়ি রয়েছে। এর মূল্য প্রায় ৪০ কোটি টাকা। বাড়িটির দ্বিতীয় তলায় তিনি থাকেন। বাকি ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া।
ময়মনসিংহের ভালুকার প্রায় ৩০০ বিঘা জমির ওপর তাঁর রপ্তানিমুখী জুতার কারখানা রয়েছে। এর নাম গ্লোবাল সুজ। রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় মতিউরের রয়েছে বিপুল সম্পদ, প্লট ও বাগানবাড়ি। জেসিএক্স নামে একটি যৌথ ডেভেলপার কোম্পানি বসুন্ধরায় ১৪ তলা বাণিজ্যিক ভবনের নির্মাণকাজ করছে। এতে তাঁর মালিকানা রয়েছে। গাজীপুর সদরের খিলগাঁও মৌজায় বিপুল পরিমাণ জমি রয়েছে তাঁর।
রাজধানীর অদূরে সাভার থানার বিরুলিয়া মৌজায় আটটি খতিয়ানে ৬০ শতাংশ এবং একই মৌজায় স্ত্রীর নামে ১৪.০৩ শতাংশ জমি রয়েছে। গ্লোবাল সুজ কোম্পানির নামে সাতটি খতিয়ানে ৬০ শতাংশ জমি রয়েছে। এর মূল্য প্রায় ৯০ কোটি টাকা। এ ছাড়া তাদের নামে বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে বেশ কয়েকটি। দুদক সূত্র জানায়, এর বাইরে তাঁর আরও সম্পদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
মুলত ক্যাডার পরিবর্তন করে বাণিজ্য ক্যাডারের ১১ ব্যাচ থেকে কাস্টমসের ১৩ ব্যাচের সঙ্গে যোগ দেন ড. মতিউর রহমান। নতুন ক্যাডারে যুক্ত হওয়ার পরই প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সম্পদ বাড়তে থাকে তার। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে যুগ্ম কমিশনারের দায়িত্বে থাকাকালে শুরু হয় এই উত্থান। বর্তমানে তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য হিসেবে কাস্টম ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট পদে দায়িত্ব পালন করছেন। মাঝে ১৫ বছরে নামে-বেনামে গড়ে তুলেছেন অঢেল সম্পদ। এই তালিকায় আছে পুঁজিবাজারের ব্রোকারেজ হাউসের অংশীদারত্ব থেকে শুরু করে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার, জমি ও বিনোদন পার্ক। সন্তানদের নামে রয়েছে ডজনখানেক কোম্পানির মালিকানা।
মতিউর রহমানের দাবি, তার বিপুল সম্পদের মূল উৎস পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ। তবে সেখানেও বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার নিয়ে রয়েছে কারসাজির অভিযোগ। এতদিন নানাভাবে এড়িয়ে গেলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘১৫ লাখ টাকার ছাগল’কাণ্ডে আলোচিত হওয়ার পর বেরিয়ে এসেছে থলের বিড়াল। দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণের নিজস্ব অনুসন্ধানে এই কাস্টমস কর্মকর্তার বিপুল পরিমাণ সম্পদের নানা তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে।
মতিউর রহমান দাবি করেছেন, পুঁজিবাজারে তিনি প্রচুর টাকা কামিয়েছেন। তিনি নিজেকে একজন অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারী বলেও দাবি করেছেন। সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষতকারে তিনি এই দাবি করেন। শুধু মেয়ের নামে বিনিয়োগ করেই ১ কোটি টাকায় ১৪ কোটি টাকা মুনাফা করেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। তবে নিজেকে দক্ষ বিনিয়োগকারি দাবি করলেও তার বক্তব্যের মধ্যে সুবিধাভুগী লেনদেন নিষিদ্ধকরণ আইন (বাংলাদেশ সিকিউরিটিস অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (ইনসাইডার ট্রেডিং) রুল) লংঘন এবং কারসাজির আভাস পাওয়া গেছে।
টেলিভিশনে দেওয়া ওই সাক্ষতাকারে মতিউর রহমান দাবি করেন, তিনি বুদ্ধি ও পরিশ্রমের মাধ্যমে পুঁজিবাজারকে কাজে লাগিয়ে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। তার দাবি, তিনি দুর্বল কিন্তু সম্ভাবনাময় কোম্পানির মালিকদের সাথে বসে ওই কোম্পানির উন্নয়নের পরিকল্পনা করেন।
ওই পর্যায়ে তিনি কম দামে বিপুল সংখ্যক শেয়ার কিনে নেন, পরে কোম্পানি কিছুটা ভাল করলে উচ্চ দামে ওই শেয়ার বিক্রি করে বিপুল মুনাফা করেন। ট্যানারি খাতের কোম্পানি ফরচুন সু’র মালিকরা তার কাছের মানুষ জানিয়ে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, তাকে ওই কোম্পানির মালিকরা ৮ টাকা দামে শেয়ার দিয়েছিল। পরে তিনি ৫৪ টাকা দামে ওই শেয়ার বিক্রি করে অনেক মুনাফা করেছেন।
তিনি আরও দাবি করেন, তিনি একটি জমি বিক্রি করে সাড়ে ৪ কোটি টাকা পেয়েছিলেন। পরে ওই টাকা থেকে শেয়ারবাজারে ২ কোটি টাকা নিজের নামে এবং ১ কোটি টাকা তার মেয়ে ফারহানা রহমানের নামে বিনিয়োগ করে শুধু তার মেয়ের বিনিয়োগ থেকেই তিনি ১৪ কোটি টাকা মুনাফা করেছেন। আলোচিত মতিউর এক কোটি টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে ১৪ কোটি টাকা মুনাফা করেছেন।
অর্থাৎ মুনাফার হার ১৪০০ শতাংশ। নিজের নামে করা বিনিয়োগ থেকে কত লাভ হয়েছে তা প্রকাশ না করলেও অনুমান করা যায় ২০/২৫ কোটি টাকার কম নয়। এদিকে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে পুঁজিবাজারে মন্দা চলছে। এই বাজারে সিংহভাগ বিনিয়োগকারী বিপুল লোকসানের শিকার হলেও মতিউরের এই অবিশ্বাস্য মুনাফা অর্জনের বিষয়টি নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, কোনো ধরনের কারসাজি ছাড়া স্বাভাবিক বিনিয়োগ থেকে এমন মুনাফা সম্ভব নয়। কেননা বড় বড় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, যাদের রয়েছে দক্ষ ও পেশাদার রিসার্চ টিম, সেসব প্রতিষ্ঠানও এই সময়ে গেড় ২০ শতাংশ মুনাফা করতে পারেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন মতিউর রহমান। পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনে (পিকেএসএফ) কর্মজীবন শুরু হয় তার। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত কাজ করেন সেখানে। সর্বশেষ উপ-ব্যবস্থাপক পদ থেকেই ১৯৯৩ সালের ১ এপ্রিল যোগ দেন কাস্টমস বিভাগে। ২০১৫ সালে পদোন্নতি পেয়ে কমিশনার হন তিনি। ২০২১ সালের ১২ আগস্ট তাকে কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালে সদস্য (টেকনিক্যাল) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্মরত।