মতিউরের প্লেসমেন্ট শেয়ার বাণিজ্যে অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেবে বিএসইসি
দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট মতিউর রহমানকে তার পদ থেকে সরিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে সংযুক্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাকে সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদ থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ অনুসন্ধানের লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে আলোচিত মতিউর রহমান ঘুষ, দুর্নীতি ও প্লেসমেন্ট শেয়ার ব্যবসা করে হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ গড়েছেন বলে অভিযোগ এনে বিভিন্ন গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ করেছে। তবে প্লেসমেন্ট শেয়ার ব্যবসা করার ক্ষেত্রে তিনি কোনও অনিয়ম করেছেন কি না, সে বিষয়ে এখনও সুনির্দিষ্ট কোনও অভিযোগ পায়নি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। অভিযোগ হাতে পেলেই তার বিরুদ্ধে সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে কমিশন সূত্রে জানা গেছে।
প্রখ্যাত সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী মৃত্যুর আগে এক কলামে লিখেছিলেন, ‘নব্য আওয়ামী লীগ সেজে বহু স্বাধীনতাবিরোধী সুবিধা ভোগ করছে। এর জন্য প্রধানমন্ত্রীকে একসময় ভুগতে হবে।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মতিউরের বাবা যেমন রাজাকার ছিলেন, তার প্রথম স্ত্রীর বাবাও ছিলেন রাজাকার। অথচ তিনি এখন আওয়ামী লীগের হয়ে নরসিংদীর রায়পুরার উপজেলা চেয়ারম্যান। আবার যে তিন প্রভাবশালী তাকে প্রশ্রয়ে দিয়েছেন, তাদের এক জনের বাবাও রাজাকার। এরা সবাই একত্র হয়ে এখন আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে গেছেন। অনেকেই প্রশাসনে এমন ছদ্মবেশীদের খুঁজে বের করার দাবি তুলেছেন।
তবে মতিউরকে প্রশ্রয় দেওয়া তিন প্রভাবশালীর এক জন ক্ষমতাধর সচিব। এক জন প্রশাসন ক্যাডারের অত্যন্ত প্রভাবশালী কর্মকর্তা। আরেক জন বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম শীর্ষ পদে আছেন। তার বদৌলতেই মতিউর সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হন। অন্য প্রভাবশালী হলেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের অন্যতম শীর্ষ কর্মকর্তা। যিনি শিক্ষকতা থেকে এখানে এসেছেন। তার কাছ থেকেই বিশেষ সুবিধা পেয়ে মতিউর প্লেসমেন্ট শেয়ারের কারসাজি করে হাজার হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে হাতিয়ে নিয়েছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
সম্প্রতি কোরবানির জন্য ঢাকার সাদিক এগ্রো থেকে ১৫ লাখ টাকায় একটি ছাগল কিনতে গিয়ে আলোচনার জন্ম দেন মতিউর রহমানের ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাত। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে বিভিন্ন আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় বইছে। আর এ সব অভিযোগ আমলে নিয়ে মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, মতিউর রহমান ঘুষ এবং শেয়ার ব্যবসা উভয় প্রক্রিয়ায় অঢেল টাকার মালিক বনে গেছেন। এখন পর্যন্ত শুধু প্রাইভেট প্লেসমেন্ট প্রক্রিয়ায় ২০ কোম্পানিতে নিজ নাম ছাড়াও স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, বোনসহ কয়েকজন নিকটাত্মীয় এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোম্পানির নামে ২০১০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত শেয়ার নেওয়ার তথ্য মিলেছে।
মতিউর নিজের ও আত্মীয়স্বজনের নামে যে পরিমাণ প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়েছেন, অভিহিত বা প্রকৃত মূল্য হিসাবে এসব শেয়ারের দাম অন্তত অর্ধশত কোটি টাকা। এর দু-একটি বাদে সব কোম্পানি আগেই শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। তালিকাভুক্তির পর প্লেসমেন্ট প্রক্রিয়ায় নেওয়া এসব শেয়ার উচ্চমূল্যে বিক্রি করে কয়েকশ কোটি টাকা মুনাফা করেছেন মতিউর রহমান।
এদিকে, মতিউর রহমান লেসমেন্ট প্রক্রিয়ায় যেসব শেয়ার পেয়েছেন, তার অনেকগুলোর বিরুদ্ধে আইপিও প্রক্রিয়ায় শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে আর্থিক প্রতিবেদনে জালিয়াতি করে মুনাফা বাড়িয়ে দেখানোর অভিযোগ আছে। আর্থিক প্রতিবেদনে জালিয়াতি ঢাকতে এনবিআরে কর ও ভ্যাট দেওয়ার নথিও জাল করার প্রয়োজন পড়ে।
যারা জাল-জালিয়াতিতে পূর্ণ আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করেন এবং যেসব কর্মকর্তা এ কাজে সহায়তা করেন, তাদের অধিকাংশই ঘুষের পরিবর্তে শেয়ার নেন। এতে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির মালিকপক্ষের নগদে অনেক টাকা বেচে যায়। আবার কোনও বিনিয়োগ ছাড়াই ভুয়া শেয়ার নিয়ে বিপুল অঙ্কের অর্থ শেয়ারবাজার থেকে হাতিয়ে নেন সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা। মতিউরের বিরুদ্ধেও এমন অভিযোগ রয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে থেকে জানা গেছে, মতিউর প্লেসমেন্ট প্রক্রিয়ায় যেসব কোম্পানির শেয়ার নিয়েছেন, সেগুলো হলো– এক্মি পেসটিসাইডস (৩৮ লাখ শেয়ার), অনিক ট্রিমস (৫৩.১৯ লাখ), অ্যাসোসিয়েটেড অক্সিজেন (১০ লাখ), বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার (৭৫ হাজার), সিএনএটেক্স (১০.৩০ লাখ), ডমিনেজ স্টিল (১৫.৮০ লাখ), ই-জেনারেশন (৫০ হাজার), ফরচুন সুজ (৪৩.১০ লাখ), কাট্টলী টেক্সটাইল (২১ লাখ), ল্যুবরেফ (৮ লাখ), মামুন এগ্রো (৩৭.৮৭ লাখ), এমএল ডাইং (১৬ লাখ), রিং সাইন (১০ লাখ), এসকে ট্রিমস (৯০ লাখ), টেকনো ড্রাগস (১.৫০ লাখ), ওয়েব কোস্টস (১৩.৯৭ লাখ) শেয়ার। প্যাসিফিক ডেনিম এবং সিলভা ফার্মারও কিছু শেয়ার আছে। এর মধ্যে এসকে ট্রিমস কোম্পানি নিজেই গড়েছেন মতিউর। তবে এর বাইরেও তার নামে আরও শেয়ার থাকতে পারে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পেরেছি যে, মতিউর রহমান অনেক কোম্পানির প্লেসমেন্ট শেয়ারে বিনিয়োগ করেছেন। প্লেসমেন্ট শেয়ারের বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ ল’স, রুলস ও রেগুলেশনসের কোনও বাধা নেই।
ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান প্রাইভেট প্লেসমেন্টর মাধ্যমে শেয়ার অফার করলে, সেখানে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। তবে সেখানে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব প্রক্রিয়ায় (আইপিও) বা তালিকাভুক্ত কোনও কোম্পানির মূল্য সংবেদনশীল তথ্যের ভিত্তিতে লেনদেনের ক্ষেত্রে তার কোনও অনিয়ম রয়েছে কি না, সে বিষয়টি বিএসইসি দেখতে পারে। তবে বিএসইসির কাছে এখন পর্যন্ত এমন কোনও তথ্য নেই।
এ সংক্রান্ত কোনও অভিযোগও কমিশনে আসেনি। তবে তার বিরুদ্ধে যদি কোনও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ কমিশনে জমা পড়ে বা কোনও তদন্তকারী সংস্থা কমিশনের কাছে যদি তথ্য চায়, তখন প্রয়োজনবোধে সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে, পুঁজিবাজার বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আল-আমীন সাংবাদিকদের জানান, বিএসইসির তদন্তে এরই মধ্যে প্রমাণিত যে, মতিউর রহমান রিং সাইন টেক্সটাইলের যে ১০ লাখ শেয়ার নিয়েছেন। তার অভিহিত মোট মূল্য ১ কোটি টাকা। তবে তার জন্য তিনি কোনও টাকা দেননি। তাহলে তাকে কেন এতোগুলো শেয়ার দেওয়া হয়েছিল? এ বিষয়টির পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হওয়া দরকার।