দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ছাগলকাণ্ডে দেশজুড়ে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদ্য সাবেক সদস্য মতিউর রহমানসহ সংশ্লিষ্ট সবার ব্যাংক হিসাব স্থগিত করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি বাংলাদেশে কার্যরত সকল শেয়ারবাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান ও মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বা বিএফআইইউ। এতে

আগামী ৩০ দিনের জন্য মতিউরসহ তার স্ত্রী-সন্তানদের ৮টি ব্যাংক হিসাব স্থগিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র মতে, ড. মোঃ মতিউর রহমান, তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ, দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিবলী, দ্বিতীয় স্ত্রীর মেয়ে ইফতিমা রহমান মাধুরী, দ্বিতীয় স্ত্রীর আলোচিত ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাত, প্রথম স্ত্রীর মেয়ে ফারজানা রহমান (ইপসিতা), প্রথম স্ত্রীর ছেলে আহাম্মেদ তৌফিকুর রহমান এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর ছেলে ইরফানুর রহমান ইরফানের মালিকানায় থাকা মোট আটটি ব্যাংক হিসাব স্থগিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়।

এছাড়া আগামী ৫ কার্যদিবসের মধ্যে এসব ব্যাংক হিসাব খোলার ফরম, কেওয়াইসি, লেনদেন বিবরণী ইত্যাদি তথ্যাদি সরবরাহের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ক্ষমতাবলে এ নির্দেশনা জারি করে বিএফআইইউ।

সূত্র জানায়, মতিউর রহমান এবং তার স্ত্রী-সন্তান ছাড়াও তার লেনদেনের সাথে সংশ্লিষ্ট সবার ব্যাংক হিসাব স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাংক নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ। পর্যায়ক্রমে বাকিদের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করার নির্দেশ দেওয়া হবে।

এবার কোরবানির ঈদে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সাদিক অ্যাগ্রো থেকে মতিউর রহমানের ছেলে মুশফিকুর রহমান ১৫ লাখ টাকায় একটি ছাগল কেনা ছাড়াও ঢাকার বিভিন্ন খামার থেকে ৭০ লাখ টাকার গরু কিনেছেন বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। এর পর থেকে মতিউর রহমানের ছেলের দামি ব্র্যান্ডের ঘড়ি, গাড়ি, আলিশান জীবনযাপন এবং মতিউর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে রিসোর্ট, শুটিং স্পট, বাংলোবাড়ি, জমিসহ নামে-বেনামে সম্পত্তি থাকা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।

জানা যায়, মতিউর রহমান সরকারি চাকরি করে দুই স্ত্রী, পাঁচ সন্তান ও আত্মীয়স্বজনের নামে গড়েছেন কয়েক হাজার কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ। এরই মধ্যে দেশেই প্রায় ৫০০ কোটি টাকার স্থাবর সম্পদের হদিস মিলেছে। ঢাকা, গাজীপুর, সাভার, নরসিংদী ও বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট ও প্লট রয়েছে। এছাড়াও সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের নামে এফডিআর ও শেয়ারবাজারে নিজ নামে অর্ধশত কোটি টাকা বিনিয়োগ আছে। এমনকি ছাগলকাণ্ডে আলোচিত তরুণকেও কিনে দিয়েছিলেন প্রাডো, প্রিমিও ও ক্রাউনের মতো ৪টি বিলাসবহুল গাড়ি। এসব গাড়ি তার বিভিন্ন কোম্পানির নামের রেজিস্ট্রেশন করা।

এছাড়া ঢাকাতেই অন্তত ২ ডজন বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে মতিউর রহমানের স্ত্রী-সন্তান ও ঘনিষ্ঠদের নামে। বসুন্ধরার ডি ব্লকের ৭এ রোডের ৩৮৪ নম্বর ভবনের মালিক তিনি। সাত তলা ভবনের প্রথম দ্বিতীয় তলায় প্রথম স্ত্রী নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার চেয়ারম্যান লায়লা কানিজকে নিয়ে সপরিবারে বাস করেন। গুলশানের সাহাবুদ্দিন পার্কের পাশে ৮৩ নম্বর রোডের ১১ নম্বর প্লটে আনোয়ার ল্যান্ডমার্কের বেগ পার্ক ভিউতে রয়েছে ৪টি ফ্ল্যাট।

দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার থাকেন লালমাটিয়ার ৮নং রোডের ৪১/২ ইম্পেরিয়াল ভবনে। কাকরাইলেও একটি ফ্ল্যাট রয়েছে ছোট স্ত্রীর নামে। টঙ্গীতে ৪০ হাজার বর্গফুটের এসকে ট্রিমস নামে ব্যাগ ম্যানুফ্যাকচারিং ও এক্সেসরিজ কারখানা আছে তার। গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে নানা দাগের জমি। সব মিলিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য মতিউর রহমান কয়েক বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন।

এনবিআরের সাবেক এ কর্মকর্তা কীভাবে এত টাকা সম্পদ গড়েছেন তার হদিস এখনো মিলেনি। এর আগেও ২০০৪, ২০০৮, ২০১৩ ও ২০২১ সালে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগে মতিউরের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে দুদক। চার দফায় মতিউর দুদকের জাল ভেদ করে অভিযোগমুক্ত হয়েছেন। গতকাল ফের মতিউরের অঢেল সম্পদ নিয়ে তদন্তে নেমেছেন বলে জানিয়েছেন দুদক সচিব।

এদিকে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অন্যান্য অভিযোগের ভিত্তিতে মতিউর রহমানকে সম্প্রতি এনবিআর থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত (ওএসডি) করা হয়েছে। এছাড়া তার স্ত্রী লায়লা কানিজ এবং ছেলে আহম্মেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি পুঁজিবাজারে কারসাজি করার বিও হিসাব ফ্রিজেরও নির্দেশনা আসার সম্ভবনা রয়েছে।

সূত্র জানায়, মতিউর দুটি ব্রোকারেজ হাউজে নিজের পাশাপাশি স্ত্রী, ছেলে-মেয়ের নামে খোলা পাঁচটি বিও হিসাব থেকে প্রায় ৩৬ কোটি টাকা মুনাফা তুলেছেন। এছাড়া পরিবারের সদস্য, নিকটাত্মীয়, বন্ধু-বান্ধবদের নামে খোলা আরও প্রায় ১৫টি বিও হিসাব মতিউর নিজে পরিচালনা করতেন। এসব বিও হিসাবের মাধ্যমে প্লেসমেন্ট বাণিজ্য ছাড়াও বাজারে নানান কারসাজি চালিয়ে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করেছেন। তবে এক ছাগলকাণ্ডে নিজের অবৈধ সম্পত্তিসহ সব হারাতে বসেছেন এই সরকারি কর্মকর্তা।