আলমগীর হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এরই মধ্যে দেশজুড়ে আলোড়ন তোলা পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ এবার পাসপোর্ট কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে যেতে পারেন। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধানের মধ্যেই বেনজীর ও পরিবারের সদস্যদের জন্য করা ৫টি পাসপোর্টে জালিয়াতির অভিযোগ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পুলিশের কর্মকর্তা বেনজীর তার নিজের পেশাগত পরিচয় গোপন করে বেসরকারি চাকরিজীবী পরিচয়ে সাধারণ পাসপোর্ট নেন। সূত্রমতে, পাসপোর্ট অধিদপ্তরের আইন অনুযায়ী বেনজীরের এহেন জালিয়াতি প্রমাণ হলে তার দুই বছরের জেল হতে পারে।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ৮ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে বেনজীর পরিবারের সম্পদ অনুসন্ধান সংক্রান্ত দুদক টিম। গতকাল মঙ্গলবার দুদক প্রধান কার্যালয়ে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদকের উপপরিচালক মো. হাফিজুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের অনুসন্ধান টিম। দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা উপপরিচালক আকতারুল ইসলাম সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে এ জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

মুলত সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আসার পর নতুন করে আবার আলোচনায় আসেন তিনি। গণমাধ্যমে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর তিনি অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। প্রথমে এ ব্যাপারে তিনি মুখ না খুললেও গত ২০ এপ্রিল তার ফেসবুক পোস্টে একটি বক্তব্য দেন। সেখানে তার বিরুদ্ধে আসা দুর্নীতির অভিযোগকে ‘বায়োবীয়’ বলে আখ্যায়িত করেন। এরপর তিনি অনেকটা লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। অতি কাছের লোকজনই তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। পরে চারদিকে গুজব ওঠে যে সাবেক এই আইজিপি বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন সূত্রে জানা গেছে, গত ৪ মে রাত পৌনে ১০টার দিকে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের একটি বিমানে করে সিঙ্গাপুরে চলে যান। তিনি বিমানবন্দরে চ্যামেলি লাউঞ্জ ব্যবহার করেছেন। বেনজীরের ঘনিষ্ঠ ঢাকা মহানগর পুলিশের এক যুগ্ম কমিশনার জানান, সিঙ্গাপুরে দুই সপ্তাহ থাকার পর গত ১৮ মে তিনি দুবাইয়ে চলে যান। সিঙ্গাপুরে তিনি চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন। ওই দেশের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে বেনজীর এবং তার স্ত্রী চিকিৎসা করিয়েছেন। চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর বেনজীরের শরীরে একাধিক রোগ বাসা বেঁধেছে। বেনজীর আহমেদ বর্তমানে দুবাইয়ে অবস্থান করছেন।

সেখানে তার এক ব্যবসায়িক অংশীদারের ফ্ল্যাটে রয়েছেন। দুবাইয়ে তিনি আরও বেশি দিন থাকবেন বলে জানা গেছে। বেনজীরের অন্যতম প্রিয় দেশ তুরস্ক। চাকরির সময় তিনি একাধিকবার ওই দেশে গেছেন। ওই দেশ ভ্রমণকালীন তোলা ছবিগুলো তার ফেসবুক প্রোফাইলেও রয়েছে। সেখানে পুরো ফ্যামিলি নিয়ে তিনি স্থায়ী হওয়ার চিন্তা করছেন। তুরস্কে তার দীর্ঘদিনের বন্ধু রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী শফিউর রহমান বসবাস করেন। তার তুরস্কের ‘ইজমিরে’ দুটি বড় রেস্তোরাঁ রয়েছে।

তার ওই সব রেস্তোরাঁ বাংলাদেশ ও ভারতের নাগরিকদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। সেখানে বাঙালি খাবারও পাওয়া যায়। জানা গেছে, শফিউরের ইজমিরে চারটি ফ্ল্যাট রয়েছে। দুটি ফ্ল্যাটে শফিউর ও তার এক নিকটাত্মীয় থাকলেও আরও দুটি ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া রয়েছে। জানা গেছে, ওই দুটি ফ্ল্যাটের মধ্যে যেকোনো একটি ফ্ল্যাটে তিনি উঠবেন। তাকে সেখানে স্থায়ী করার বিষয়ে শফিউর ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছেন। তার গ্রিন সিগ্যনাল পেলেই তিনি দুবাই থেকে তুরস্কে চলে যাবেন।

শফিউর ছাড়াও তার একাধিক বন্ধু এতে সহযোগিতা করছেন। তারা সেখানে তাকে স্থায়ী হওয়ার জন্য সব ধরনের সহযোগিতা করবেন বলে জানা গেছে। বেনজীরের সেখানে ব্যবসা করারও পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা গেছে। তবে তিনি কী ব্যবসা করবেন, তা আপাতত সিদ্ধান্ত হয়নি। বেনজীরের ঘনিষ্ঠজন সূত্রে জানা গেছে, বেনজীর আহমেদ ২০১৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর অবসর গ্রহণের পর সাদামাটা সামাজিক অনুষ্ঠানে খুব একটা যেতেন না। তবে নিয়মিত ক্লাব পার্টিগুলোতে অংশ নিতেন।

তিনি রাজধানীর তুরাগের বোট ক্লাবের সভাপতি ছিলেন। কিছুদিন হলো ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে তিনি সেখানে থেকে অব্যাহিত চেয়েছেন। ক্লাব তাকে অব্যাহতি দিয়েছে বলে জানা গেছে। পুলিশের বিভিন্ন পদে চাকরি করার সময় তিনি অত্যন্ত দাপটের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন সময় দায়িত্ব পালন করার সময় অত্যন্ত দক্ষতা ও চৌকসতার পরিচয় দেওয়ার কারণে ক্ষমতাসীনদের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন সময়ে তিনি বিভিন্ন বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় আসেন। তবে কিছু বক্তব্য দিয়ে তিনি সমালোচনার মুখোমুখি হন।

ঘনিষ্ঠ সূত্র আরও জানায়, বেনজীরের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসার পর অনেকেই উষ্মা প্রকাশ করেন। অনেকেই আশ্চর্য হয়ে যান যে কীভাবে এত অল্প সময়ে তার এত সম্পদ গড়ে উঠল। দুদক যখন তার অবৈধ সম্পদের তদন্ত শুরু করে, তখন সবাই নড়েচড়ে ওঠে। দুদক তাকে সম্পদের হিসাবের জন্য হাজির হতে বললে তিনি হাজির হননি বরং অব্যাহতি চেয়ে আবেদন করেছেন।

তার বিরুদ্ধে যখন দুদক তদন্ত শুরু করে, তখন তিনি ক্ষমতাসীনদের একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। কিন্তু কেউ তাকে ভরসা দিতে পারেননি। অনেকেই এড়িয়ে গেছেন। বেনজীর পরিস্থিতি দ্রুতই আঁচ করতে পারেন এবং তিনি দ্রুতই দেশ ছেড়ে যান। তার দেশ ছাড়ার বিষয়টি পরে সবাই জানতে পারেন। তার অনেক ঘনিষ্ঠজন তার দেশ ছাড়ার বিষয়টি জানতেন না।