তৌফিক ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: রাজধানীতে ক্ষমতাসীন দলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি শাখা হচ্ছে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ দক্ষিণ ও উত্তর শাখা। মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের অন্তর্গত সব থানা ও ওয়ার্ড শাখার সম্মেলন শেষ হওয়ার পর দীর্ঘদিন পার হলেও দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বে ও নানান জটিলতায় ঝুলে ছিল কমিটি গঠনের বিষয়টি। অবশেষে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কাছে প্রস্তাবিত খসড়া কমিটি জমা দেওয়া হয়েছে। তবে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে এ কমিটিগুলোর নাম জমা দেয়া হয়। আর এ জমা দেয়ার পরই সৃষ্টি হয়েছে চাঞ্চল্য। অভিযোগ উঠেছে যে, ঢাকা উত্তর এবং দক্ষিণে ওয়ার্ড এবং থানা আওয়ামী লীগের কমিটি গঠনে নজিরবিহীন পদ-বাণিজ্য হয়েছে।

তবে খসড়ায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে বিতর্কিত, সমালোচিত, হাইব্রিড, স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে। অনেকেই পদ পেতে তদবির করছেন। আর্থিক লেনদেনের অভিযোগও উঠেছে। এমনকি এক ব্যক্তি একাধিক পদে থাকতে পারবেন না বলে দলের সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশনা উপেক্ষা করে বেশিরভাগ কাউন্সিলরকে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদে আনতে যাচ্ছে উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ।

লাখ লাখ টাকার বিনিময় হয়েছে এবং এর সাথে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা জড়িত। এবিষয়টি জানার পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এনিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যেই বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার গোচরে এসেছে। তিনি এনিয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছেন তার নির্দেশে এই কমিটি গুলো স্থগিত হয়ে আছে। আওয়ামী লীগের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, এই কমিটি গুলো অনুমোদিত হচ্ছে না। এগুলো বাতিল হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী কারা কারা পদ-বাণিজ্য করেছেন তা খতিয়ে দেখার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম ঢাকা মহানগরের দায়িত্বে আছেন। তিনি এখন দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তিনি এলে এব্যাপারে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতি খবর পেয়েছেন, লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে কমিটিতে লোক নেয়া হয়েছে। এনিয়ে আওয়ামী লীগের অন্তত দু’জন প্রেসিডিয়াম সদস্যের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন বলেও জানা গেছে। আওয়ামী লীগের যে দু’জন প্রেসিডিয়াম সদস্য এ মহানগরীর কমিটিগুলোর দেখভালের দায়িত্বে আছেন তাদের পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বলেছেন এবং কারা কত টাকা খেয়েছে তার হিসেবও বের করতে বলেছেন। পদ-বাণিজ্য করে কমিটিতে নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সেই কমিটিগুলো আর অনুমোদিত হচ্ছে না।

জানা গেছে, ২০১৯ সালের ৩০ নভেম্বর ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে দক্ষিণের সভাপতি হিসেবে আবু আহমেদ মন্নাফী ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে হুমায়ুন কবির এবং উত্তরে শেখ বজলুর রহমান ও এস এম মান্নান কচি সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। প্রায় পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও থানা ও ওয়ার্ড কমিটি দিতে তারা ব্যর্থ হন। এরপর কমিটি গঠনের কার্যক্রম তদারকির জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় দুই সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যকে, তারাও ব্যর্থ হন।

দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের থানা ও ওয়ার্ডের কমিটি চূড়ান্ত করে জমা দিতে ২০২৩ সালের ২০ মার্চ পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন। তাতেও কাজ না হওয়ায় চলতি বছরের ৩১ মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয় দলের উচ্চপর্যায় থেকে। এরপর গত ৪ জুন ঢাকা মহানগর উত্তর ও ১১ জুন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম প্রস্তাব করে দলের সাধারণ সম্পাদকের কাছে জমা দেয়। বিষয়টি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে জানানো হলে তিনি ওবায়দুল কাদেরকে কমিটি চূড়ান্ত করতে বলেন।

সূত্র জানায়, খসড়ায় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে যাদের নাম রয়েছে তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। এর মধ্যে মামলার আসামি, মাদক কারবারি, চাঁদাবাজি, নব্য আওয়ামী লীগার এবং দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গে অভিযুক্ত হয়ে বহিষ্কৃতদের নাম রয়েছে। রাজনীতিতে পূর্বে কোনো পদ না থাকলেও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতির ছেলের বন্ধু ও সাধারণ সম্পাদকের ভাই ও ভাগনেসহ অনেকেরই নাম রয়েছে খসড়ায়। এ নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ।

এ বিষয়ে গত সোমবার সন্ধ্যায় ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ে তলব করা হয় নগর দক্ষিণের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে। খসড়া কমিটির অসামঞ্জস্যতার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তারা একে অন্যকে দোষারোপ করেন। সমাধান না হলে কমিটি দলের সভাপতির কাছে উপস্থাপন করা হবে না বলেও হুঁশিয়ারি দেন। এ সময় ঢাকার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী এমপির এলাকায় কমিটি নিয়ে নয়ছয় করায় বিষয়েও জানতে চান দলের সাধারণ সম্পাদক। সূত্রে জানা যায়, ঢাকা-৯ আসনের এমপি ও মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর পরামর্শ না শোনায় তিনি দলীয় প্রধানের কাছে নালিশ করেন। ঢাকা-৭ আসনের এমপি মোহাম্মদ সোলায়মান সেলিম ও ঢাকা-৬ আসনের এমপি সাঈদ খোকনের এলাকায় কমিটির বিষয়ে অবগত না করায় তারা দলের সাধারণ সম্পাদকের কাছে নালিশ করেন।

জানা গেছে, মতিঝিল থানার অন্তর্গত ৯ নম্বর ওয়ার্ডে সাধারণ সম্পাদকের পদ পেতে যাচ্ছেন ওয়াহিদুর রহমান চৌধুরী ওয়াহিদ। তিনি দক্ষিণের সভাপতি মন্নাফীর ছেলে আহমেদ ইমতিয়াজ আহমেদ গৌরবের বাল্যবন্ধু ও ব্যবসায়ী অংশীদার। এই ওয়ার্ডে সভাপতি পদে প্রস্তাব করা হয়েছে শাহিনুর রহমান শাহীনের নাম। যার বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে এবং এ-সংক্রান্ত কয়েকটি মামলা চলমান রয়েছে। বেশ কয়েকবার শাহীন জেলও খাটেন। ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গেও সে সম্পৃক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে।

১০ নম্বর ওয়ার্ডে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রস্তাব করা হয়েছে মাহবুবুল হক হীরককে। ক্যাসিনো কর্মকাণ্ডের জন্য কাউন্সিলর পদ থেকে বরখাস্ত মোস্তাবা জামান পপি পদ পেতে যাচ্ছেন পল্টন থানায়। ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আ ফ ম ইফতেখার রহমান জয়ের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। শাহজানপুর থানাধীন ১১ নম্বর ওয়ার্ডে সাধারণ সম্পাদক হচ্ছেন ক্যাসিনোকাণ্ডে গ্রেপ্তার খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার ঘনিষ্ঠ নুরের নবী ভূঁইয়া রাজু ও বি এম ফরহাদ অংকুর। তাদের বিরুদ্ধেও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।

মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হতে যাচ্ছেন শেখ এনায়েত করিম বাবলু। মন্নাফীর ছেলে গৌরব পেতে যাচ্ছেন ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতির পদ। গৌরব কাপ্তানবাজারে মুরগির বাজারের মুরগি বেচাকেনার পাশাপাশি আশপাশের এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন। তার হয়ে চাঁদা তুলতে রয়েছে ৩০ থেকে ৪০ জনের বিশাল বাহিনী। এদিকে দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুনের ভাগনে ও ভাই পেতে যাচ্ছেন ওয়ার্ড ও থানায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদ। হুমায়ুনের ভাই কাউন্সিলর মকবুল হোসেন লালবাগ থানার সভাপতি পদে ও ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক হতে যাচ্ছেন আপন ভাগনে বখতিয়ার হোসেন।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির বলেন, অনেকের পরিবারের ৫ থেকে ১০ সদস্য পদে রয়েছে। পরিবারের লোক যদি ত্যাগী ও ভালো হয়, মাঠে-ময়দানে থাকে তাহলে সমস্যা কোথায়। তবে আমরা চাই, যাচাই-বাছাই করেই কমিটিতে পদ দেওয়া হোক। আমাদের কাজ কমিটি দেওয়া, আমরা দিয়েছি।

এখন দলের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক যেভাবে বলবেন, সেভাবে কমিটি হবে। মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের অনেক কাউন্সিলরকে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া এদের অনেকেই হত্যাসহ মাদক, চাঁদাবাজি মামলার আসামি। অনেকে পদ পেতে আর্থিক লেনদেনও করছেন। মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের এক সাংগঠনিক সম্পাদক ও একজন সম্পাদক এই আর্থিক লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সভাপতি শেখ বজলুর রহমানের সঙ্গে ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডের পদপ্রত্যাশী আকবরের এ-সংক্রান্ত কথোপকথন ফাঁস হয়।

তবে আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার ও সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র দাবি করে শেখ বজলুর রহমান বলেন, কমিটি জমা দিয়েছি। কিন্তু এ নিয়ে স্থানীয় এমপিসহ নানান জনের নানান অভিযোগ রয়েছে। কমিটিতে যাদের নামে প্রস্তাব করেছি তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই, তা নয়। তবে যাচাই-বাছাই করে শেষ পর্যন্ত কমিটি প্রকাশ করা হবে। দলের সভাপতি জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে চীন সফরে যাওয়ার পূর্বে কমিটি চূড়ান্ত করবেন।

এদিকে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের সভাপতির অফিস সূত্রে জানা যায়, কমিটি জমা দেওয়ার পর থেকেই ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণের প্রস্তাবিত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের পাহাড় জমেছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দপ্তরেও অভিযোগ জমা পড়েছে। অনেকে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে সশরীরে এসে অভিযোগ দিয়েছেন।