স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ছাগলকাণ্ডের আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা ড. মতিউর রহমানের আরও অনেক কীর্তিকলাপের খবর একের পর এক বেরিয়ে আসছে। জানা গেছে, এনবিআরের প্রভাবশালী এই কর্মকর্তা পুঁজিবাজার কারসাজির সঙ্গে সরাসরি জড়িতদের একজন। তার বিরুদ্ধে রয়েছে বিভিন্ন ব্যক্তির ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে দখল করে নেওয়াসহ জালিয়াতির বিস্তর অভিযোগ। এনবিআরের কর্মকর্তাদের কাছে ‘ম্যানেজ মাস্টার’ হিসেবে পরিচিতি মতিউর একসময় ছিলেন বিতর্কিত ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের ঘনিষ্ঠজন।

জানা গেছে, বহুল আলোচিত ওয়ান-ইলেভেনের আগেই মতিউরের সঙ্গে দেশের বেশকিছু বড় শিল্প গ্রুপ ও বিতর্কিত ব্যবসায়ীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ওয়ান-ইলেভেনের জরুরি অবস্থার সময়ও তিনি একজন উপদেষ্টার সঙ্গে সখ্য থাকার সুবাদে পার পেয়ে যান। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিনি ওপর মহলকে ম্যানেজ করে চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনারসহ লোভনীয় পদে নিয়োগ পান।

গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক কর্মকতা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এনবিআরের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালনকালে কোটি কোটি বিদেশে পাচার করেছেন মতিউর রহমান। নারী কেলেঙ্কারির সাথেও সে জড়িত। এনবিআরের কোন কর্মকর্তার নির্দেশনা তিনি মানতেন না। ফলে ছাগলকাণ্ডে দেশজুড়ে আলোচিত মতিউর রহমান পুঁজিবাজারের এক ‘দুঃসাহসী খলনায়ক’।

পুঁজিবাজার নিয়ে এক যুগেরও বেশি সময় চলছে মতিউর রহমানের অবিশ্বাস্য ভেলকি। ধরাকে সরা জ্ঞান করে গাছের খাচ্ছেন, তলারও কুড়াচ্ছেন। ‘গভীর জলের মাছ’ হয়ে পুঁজিবাজারের নানা চোরাপথে হেঁটেছেন মতিউর রহমান। এই যেমন, আইপিওর আগে এক পয়সাও লগ্নি না করে জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া শেয়ার ইস্যু করেন। বাজারে আসার আগেই প্রথমে এ শেয়ারের কিছু অংশ প্রাইভেট প্লেসমেন্ট প্রক্রিয়ায় বিক্রি করে নগদ টাকা লুটে নেন। পরে ওই কোম্পানিকে বাজারে তালিকাভুক্ত করে বাকি শেয়ার বেচে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালে মতিউর রহমান চট্টগ্রাম কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার থাকাকালে সাইমুম অ্যাসোসিয়েটস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করেন। এরপর এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমান, ব্যবসায়ী মো. মোর্শেদ ও তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে দুটি দুর্বল কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

তারা মতিউর রহমানের খালাতো ভাই নেছার উদ্দিন সোহাগ এবং ভাইয়ের স্ত্রীকে পরিচালক বানিয়ে ফ্যামিলি টেক্স (বিডি) ও সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইলকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করেন। এ দুটি দুর্বল প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কিনে পথে বসেছেন শতশত বিনিয়োগকারী। ফ্যামিলি টেক্সের ৭৪ টাকা ৮০ পয়সা শেয়ারের দাম হয়েছে মাত্র ৩ টাকা ৩০ পয়সা। এ ছাড়া সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ২০১৫ সালে। ১০ টাকা মূল্যের সাড়ে ৪ কোটি শেয়ার ছেড়ে বাজার থেকে তোলা হয় ৪৫ কোটি টাকা। দুই বছরের মাথায় ২০১৭ সালে হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হয় কোম্পানির উৎপাদন। অথচ কোম্পানি দুটি তালিকাভুক্তির আগের দুই বছরে হঠাৎ করে চার গুণ বেশি মুনাফা দেখানো হয়, যাতে তালিকাভুক্তি সহজ হয়।

শুধু তাই নয়, আপন ছোট ভাই নুরুল হুদার সই-স্বাক্ষর জাল করে ইফকো টেক্সটাইল নামে আরও একটি কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির চেষ্টা করেন মতিউর রহমান। ঋণসংক্রান্ত জটিলতা, ব্যাংকের আপত্তি ও সিআইবি রিপোর্ট পক্ষে না থাকায় এই চেষ্টা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। পরে ছোট ভাইকে দিয়েই চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানায় মামলা করান নিজের সহযোগী মোর্শেদ এবং একটি বেসরকারি ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে। এর উদ্দেশ্য ছিল ভাইকে ঋণের দেনার দায় থেকে মুক্ত করা। নুরুল হুদা তার দায়ের করা মামলায় দাবি করেছেন, তিনি কোনো ব্যাংকঋণ নেননি এবং কীভাবে তিনি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হয়েছেন সেটিও জানেন না।

দুর্বল প্রতিষ্ঠানকে পাবলিক প্রতিষ্ঠান করে পুঁজিবাজার থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নেছার উদ্দিন সোহাগ বলেন, মতিউর রহমান আমার খালাতো ভাই। আমি প্রতিষ্ঠানের (ফ্যামিলি টেক্স বিডি) পরিচালক ছিলাম। তবে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে কিছু বলতে পারব না। কারণ আমাদের কোনো কর্মকান্ড ছিল না। তবে সিগনেটরি হিসেবে প্রতিষ্ঠানের সব অর্থের লেনদেন তার স্বাক্ষরেই হয়েছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি চেয়ারম্যানের হয়ে কাজ করেছি। তখন চেয়ারম্যান ছিলেন কায়সার সাহেব। তিনিই ভালো বলতে পারবেন। সব কিছু তার নির্দেশে হয়েছে। এখন প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আমার ও আমার স্ত্রীর কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী মো. মোর্শেদ এবং তার সহযোগীদের ফ্যামিলি টেক্স (বিডি), সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল লিমিটেড এবং ইফকো গার্মেন্টস লিমিটেড নামে তিনটি প্রতিষ্ঠান ছিল। ছাগলকাণ্ডে আলোচিত আত্মগোপনে থাকা এনবিআরের সাবেক সদস্য মতিউর রহমান এবং ব্যবসায়ী মো. মোর্শেদ সংঘবদ্ধভাবে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে ২০১৩ সালে ফ্যামিলি টেক্সকে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি থেকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করান।

মতিউর রহমানের খালাতো ভাই নেছার উদ্দিন সোহাগকে (৪৬) প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ও ব্যাংক হিসাবের সিগনেটরি করা হয়। ২০১৫ সালে সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল লিমিটেড নামক প্রতিষ্ঠানটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি থেকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। নেছার উদ্দিন সোহাগের স্ত্রীকে প্রতিষ্ঠানের পরিচালক করা হয়। গুলশানের ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের হিসাব নম্বর ০১১২১১১০০০১৯৪৬৫-এর নমিনেটেড সিগনেটরি হয়ে তিনি কোটি কোটি টাকা লেনদেন করেন।

সংঘবদ্ধ প্রতারণা ও আত্মসাতের ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালের ২৩ জুলাই এফিডেভিটের মাধ্যমে ইফকো গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল লিমিটেডের শেয়ারহোল্ডার নাজমুল শাখাওয়াত হোসেনের ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা মূল্যের ১৪ লাখ শেয়ার মতিউর রহমানের আপন ছোট ভাই নুরুল হুদার নামে হস্তান্তর দেখিয়ে পরিচালক করা হয়। এরপর পুঁজিবাজারে লুটপাটের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠানটিকে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি থেকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরের চেষ্টা করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, দুই দুর্বল কোম্পানি ফ্যামিলি টেক্স (বিডি) ও সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইলকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন মতিউর ও তার সহযোগীরা। তবে ইফকো গার্মেন্টস ও টেক্সটাইলকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করতে না পারায় তাদের লুটপাটের পরিকল্পনা ধাক্কা খায়। প্রতিষ্ঠানের নেওয়া বিপুল ঋণের বোঝা মতিউর রহমানের ছোট ভাই নুরুল হুদার ঘাড়ে চাপে।

পরে মতিউর রহমান নিজের ছোট ভাইকে বাঁচাতে মো. মোর্শেদ ও ব্যাংক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরিকল্পনা ছিল, বিদেশে আত্মগোপনে যাওয়া তার সহযোগী মো. মোর্শেদ আর ফিরে আসবেন না। আর ব্যাংককে ফাঁসিয়ে তার ভাইকে মুক্ত করে আনবেন। কিন্তু পুলিশ তদন্ত শুরু করলে মূলহোতা হিসেবে মতিউরের নাম বেরিয়ে আসে। তিনি ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে তদন্ত কর্মকর্তা বদলে ফেলেন। একে একে পাঁচজন তদন্ত কর্মকর্তা বদল করা হয়। প্রভাব খাটিয়ে নিজে এবং ভাইকে বাঁচাতে একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার মধ্যস্থতায় একাধিক মিটিং হয়।

তবে শেষ রক্ষা হয়নি। মামলাটি এখন সিআইডির একজন ইন্সপেক্টর তদন্ত করছেন। নুরুল হুদার দায়ের করা মামলা ও তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মামলার প্রধান আসামি ইফকো গার্মেন্টস অ্যান্ড টেক্সটাইলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোর্শেদ (৫১)। তিনি অনেক আগেই বিদেশে আত্মগোপনে আছেন। মামলার দ্বিতীয় আসামি আকতার কামাল (৫২)। ঘটনার সময় তিনি চট্টগ্রামের আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও আগ্রাবাদ শাখার ম্যানেজার ছিলেন। বর্তমানে তিনি এই ব্যাংকের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কমপ্লাইয়েন্স উইংয়ের প্রধান।

ফ্যামিলি টেক্স (বিডি) লিমিটেড কোম্পানির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় কোম্পানিটি। ১০ টাকা মূল্যমানের সাড়ে তিন কোটি শেয়ার ছেড়ে তারা সংগ্রহ করে ৩৫ কোটি টাকা। কোম্পানিটির শেয়ারের দাম একপর্যায়ে ৭৪ টাকা ৮০ পয়সায় পৌঁছায়। এর পর পুঁজিবাজারে ঘোষণা না দিয়েই উদ্যোক্তা-পরিচালকরা তাদের হাতে থাকা সিংহভাগ শেয়ার বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে দেন। এর পর টানা দরপতন হতে হতে ফ্যামিলি টেক্সবিডির শেয়ারের দাম এসেছে ৩ টাকা ৩০ পয়সা।

এছাড়া টানা লোকসান দেখিয়ে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত করেছে। কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে কোম্পানির আয় ক্রমেই বাড়ছিল। তালিকাভুক্তির আগে তিন বছরের আর্থিক প্রতিবেদন জমা দিতে হয় বিএসইসিতে। সেখানে দেখা গিয়েছিল ২০১১ ও ২০১২ সালে কোম্পানিটির মুনাফা বেড়েছিল চার গুণের বেশি। চক্রটি মূলত পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির আগে লুটপাটের জন্য মুনাফা বাড়িয়ে দেখানো হয়েছিল।