হিমাদ্রির শেয়ার কারসাজিতে ৮২ কোটি টাকার মুনাফায় জরিমানা দেড় কোটি
দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে এসএমই বোর্ডে তালিকাভুক্ত হিমাদ্রি লিমিটেডের শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে তিন প্রতিষ্ঠান ও এক ব্যক্তি মাত্র ৫ মাসে ৮২ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান শেয়ার বিক্রি করে প্রায় ২ কোটি টাকা মুনাফা তুলে নিয়েছে। বাকি ৮০ কোটি টাকা অনাদায়ী বা আনরিয়ালাইজড মুনাফা।
তারা কারসাজির মাধ্যমে ৮২ কোটি টাকা মুনাফা করলেও এর বিপরীতে তাদের জরিমানা করা হয়েছে মাত্র ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। মুলত নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) সম্প্রতি হিমাদ্রির শেয়ার নিয়ে কারসাজির দায়ে এক ব্যক্তি ও তিন প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছে।
যাদের জরিমানা করা হয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) নিবন্ধিত ব্রোকারেজ হাউস ইনোভা সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল বারী ও তাঁর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান মেসার্স এআর ট্রেডার্স এবং মেসার্স অভি ব্রিকস ও মুনীর ট্রেডার্স। এ চার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রফিকুল বারী ও তাঁর প্রতিষ্ঠান এআর ট্রেডার্সকে ১ কোটি টাকা, অভি ব্রিকসকে ৬০ লাখ টাকা ও মুনীর ট্রেডার্সকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। তাদের মোট জরিমানার পরিমাণ ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
পুঁজিবাজারে কারসাজি ও নানা অনিয়মের কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গত জুন মাসে বিএসইসি যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে, সেগুলো নিয়ে সংস্থাটির প্রকাশিত মাসভিত্তিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বিএসইসির তথ্য অনুযায়ী, এসএমই বোর্ডে তালিকাভুক্ত হিমাদ্রির শেয়ারের দামে অস্বাভাবিক উত্থানের ঘটনা তদন্তের জন্য গত বছরের আগস্টে ডিএসইকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ডিএসইর তদন্ত দল গত বছরের ২৭ এপ্রিল থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৫ মাসে কোম্পানিটির শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা তদন্ত করে। তাতে ওই ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো পারস্পরিক যোগসাজশে কারসাজি করে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ানোর তথ্য উঠে আসে।
তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের ২৭ এপ্রিল হিমাদ্রির শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ৩৮ টাকা ৮০ পয়সা। টানা মূল্য বৃদ্ধির ফলে ১৭ সেপ্টেম্বর সেটির দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৪৭৪ টাকায়। সেই হিসাবে প্রায় ৫ মাসে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের বাজারমূল্য ৬ হাজার ৪৩৫ টাকা বেড়েছে। এ সময়ের মধ্যে বাজারে লেনদেন হওয়া কোম্পানিটির বেশির ভাগ শেয়ারের এবং সিরিজ লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত ছিল ইনোভা সিকিউরিটিজের এমডি রফিকুল বারী ও তাঁর মালিকানাধীন এআর ট্রেডার্স এবং অভি ব্রিকস ও মুনীর ট্রেডার্স। তারা নিজেদের মধ্যে শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে সংকট তৈরি করে শেয়ারের অস্বাভাবিক দাম বাড়িয়েছে।
এদিকে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছর হিমাদ্রি লিমিটেডের হিসাব অবরুদ্ধ করে। পরে হিসাব খুলে দেয়। এই সময়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির কিছু কর্মকর্তা কোম্পানিটির শেয়ার থেকে অস্বাভাবিক মুনাফা করেন। স্বল্প মূলধনি কোম্পানিগুলোর শেয়ার লেনদেনের জন্য গঠিত আলাদা প্ল্যাটফর্মকে বলা হয় এসএমই বোর্ড।
আর পুঁজিবাজারে নামে-বেনামে নিজেদের মধ্যে লেনদেনের মাধ্যমে শেয়ারের দাম প্রভাবিত করার ঘটনাকে সিরিজ লেনদেন বলা হয়, যা সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী অপরাধ। কারসাজিকারকেরা শেয়ারের দাম বাড়াতেই মূলত এ ধরনের লেনদেন করে থাকেন। প্রথমে কম দামে এক বা একাধিক বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাবে শেয়ার কেনা হয়। এরপর ওই শেয়ার বেশি দামে এক হিসাব থেকে অন্য হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। এভাবে কয়েক দিন নিজেদের মধ্যে হাতবদলের মাধ্যমে শেয়ারের কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করা হয়।
ডিএসইর তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের ৭ মে ও ২ জুলাই দুই দিনে হিমাদ্রির প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার শেয়ার কেনে এআর ট্রেডার্স। এসব শেয়ার কেনা হয় রফিকুল বারীর ব্যক্তিগত বিও হিসাব থেকে। একইভাবে গত বছরের ১৮ ও ২০ জুন রফিকুল বারী দুই দিনে ব্লক মার্কেট থেকে এআর ট্রেডার্সের নামে প্রায় ৩২ হাজার শেয়ার কেনেন। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, হিমাদ্রির কারসাজির ঘটনার সঙ্গে যুক্ত তিন প্রতিষ্ঠান যথাক্রমে এআর ট্রেডার্স, অভি ব্রিকস ও মুনীর ট্রেডার্সের নামে থাকা বিও হিসাবে ব্যবহার করা ঠিকানা আর রফিকুল বারীর ব্যক্তিগত বিও হিসাবের ঠিকানা একই। রাজধানীর মিরপুর ডিওএইচএসের ২ নম্বর অ্যাভিনিউর ১৩ নম্বর সড়কের একটি বাড়িকে এ চার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা হিসেবে দেখানো হয়।
যদিও বিএসইসির শুনানিতে রফিকুল বারী অভি ব্রিকস ও মুনীর ট্রেডার্সের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা ও কারসাজির অভিযোগও অস্বীকার করেন তিনি। তবে বিএসইসি মনে করে, চার বিও হিসাবের সুবিধাভোগী এক বা একাধিক ব্যক্তি। কারসাজির সুবিধার্থে একাধিক বিও হিসাব ব্যবহার করা হয়েছে।
সিরিজ লেনদেনের মাধ্যমে সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের পাশাপাশি এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কোনো ধরনের ঘোষণা ছাড়াই বাজার থেকে কোম্পানিটির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শেয়ার কিনে আইন লঙ্ঘন করেছে। নিয়ম অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ঘোষণা ছাড়া পারস্পরিক যোগসাজশে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির ১০ শতাংশ বা তার বেশি শেয়ার কিনতে পারে না। কিন্তু হিমাদ্রির শেয়ারের কারসাজির ক্ষেত্রে এ আইনেরও ব্যত্যয় ঘটেছে।