এমডি ছাড়াই চলছে ডিএসই, মতিঝিল থেকে নিকুঞ্জ গিয়ে কী পেল
শহীদুল ইসলাম ও মনির হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এমডিসহ গুরুত্বপূর্ণ তিন পদে দীর্ঘদিন ধরে কোনো কর্মকর্তা নেই। প্রতিষ্ঠানটিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নেই প্রায় দেড় মাস, ছয় মাস পেরিয়েছে চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) পদত্যাগের। শেয়ার লেনদেন অনলাইনে হলেও অব্যাহতির প্রায় দুই বছর পরও নিয়োগ দেওয়া হয়নি প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা (সিটিও)।
ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের মে মাসে এমডি নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শূন্য হওয়া সিটিও ও সিওও পদের জন্য নির্বাচিতদের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। শিগগিরই ওই পদগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হবে। ডিএসইতে তিন বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক (নবায়নযোগ্য) এমডির নিয়োগ দেওয়া হয়। এমডি পদ পেতে প্রার্থীকে অবশ্যই বিজনেস, অর্থনীতি, পরিসংখ্যান, গণিত বা আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রিসহ ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে অন্তত ১০ বছর চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
অথবা সিএফএ, সিএ, সিএমএ, সিএস, সিপিএ প্রফেশনাল ডিগ্রিসহ অন্তত ১০ বছর চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। পুঁজিবাজার বা সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিলযোগ্য। ফিনটেক, তথ্যপ্রযুক্তি ও গভর্ন্যান্স বিষয়ে জানাশোনা অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হবে। কোনো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে অন্তত ১০ বছর চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। পুঁজিবাজার বা কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কৌশলগত নেতৃত্বের সক্ষমতা থাকতে হবে। উপস্থাপনা ও যোগাযোগে দক্ষ হতে হবে।
সূত্র মতে, চলতি বছরের ১০ মার্চ সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসের শুরুতেই ডিএসইর ওয়েবসাইটে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। ১০টায় লেনদেন শুরুর পর থেকে উষ্ণ দেওয়া শুরু হয়। ওই সময় ডিএসইর ওয়েবসাইটে ডিএসই ব্রড ইনডেক্স ডিএসইএক্স আগের দিনের চেয়ে ৬ হাজার ১২ দশমিক ৩৬ পয়েন্ট বা ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ কমে দশমিক ৩৯ পয়েন্ট দাঁড়িয়েছে।
অথচ তখন পর্যন্ত বাজারে ২২৬টি কোম্পানির শেয়ার কেনাবেচা হয়েছে, যার মধ্যে ১৫৯টি কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে, যা লেনদেনে অংশ নেওয়া কোম্পানিগুলোর ৭০ দশমিক ৩২ শতাংশ। ওই সময়ে শরিয়াহ সূচক ডিএসইএসের অবস্থান দেখানো হয় দশমিক শূন্য ৪ পয়েন্ট, যা আগের দিনের চেয়ে ১ হাজার ৩৩৫ দশমিক ৮৪ পয়েন্ট বা ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ কম। অবশ্য পরে তা ঠিক হয়েছে।
ডিএসইর একাধিক সূত্র জানায়, ২০২২ সালের অক্টোরবে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ডিএসইর প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তাকে (সিটিও) বরখাস্ত করে। সেই থেকে ওই পদ শূন্য রয়েছে। দীর্ঘদিনেও পদটি পূরণ করা হয়নি।
অন্যদিকে পুঁজিবাজারের মন্দাভাব যেন কাটছেই না। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জও (ডিএসই) যেন ভাসছে লেনদেনের ভাটায়। রাজধানীর মতিঝিল থেকে নিকুঞ্জ নিয়ে আলিশান এক ভবন বানিয়েছে ঠিকই; কিন্তু তাতে মিলছে না ব্রোকারেজ হাউজের দেখা। অনেকেই আবার অফিস বন্ধ করে ছাড়ছে ডিএসইর নিকুঞ্জ ভবন। এমন বাস্তবতায় বছর ব্যবধানে সংস্থাটির আয় কমেছে ৪৪ কোটি টাকার বেশি।
দীর্ঘদিন ধরে আস্থার সংকট, লেনদেনে ভাটা, বিনিয়োগকারীদের বাজার ছেড়ে যাওয়া, আর ব্রোকারেজ হাউজগুলোর ব্যবসার মন্দায় টালমাটাল পুঁজিবাজারে এখন খোদ ডিএসই এখন ক্ষতির মুখে। এ অবস্থায় আস্থা ফেরাতে কীভাবে কাজ করবে সংস্থাটি এমন প্রশ্ন বিনিয়োগকারীসহ বাজার সংশ্লিষ্টদের। তবে ডিএসই চেয়ারম্যান হাফিজ মুহাম্মদ হাসান বাবু বলছেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটসহ নানা কারণে তারা পরিস্থিতির স্বীকার। শিগগিরই এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠবে বলে আশা তার।
২০১৯ সালের অক্টোবরে রাজধানীর মতিঝিল ছেড়ে নিকুঞ্জে আসে ডিএসই। যদিও তা খুব একটা সুফল বয়ে আনেনি দেশের পুঁজিবাজারের জন্য। এক লাখ ৪৭ হাজার বর্গফুটের ভবনটিতে বর্তমানে ভাড়ায় রয়েছে ৯৯টি ব্রোকারেজ হাউজ, যার মধ্যে ফাঁকা পড়ে আছে ৮০টিরও বেশি। আবার ব্যয় মেটাতে না পারায় ছেড়ে চলে যাচ্ছে কিছু প্রতিষ্ঠান, যার একটি প্রাইলিংক সিকিউরিটিজ লিমিটেড।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বিনিয়োগকারীর অভাবে ফাঁকা পড়ে আছে হাউজটি। একজন মাত্র লোক দিয়ে চলছে কার্যক্রম। কাঙ্ক্ষিত আয় না আসায় দুবছর আগে নিকুঞ্জে খোলা শাখা অফিসটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে প্রাইলিংক সিকিউরিটিজ লিমিটেডের ইনচার্জ বলেন, বিনিয়োগকারী নেই; তাই আমাদের ব্যবসাও নেই। ক্ষতির মুখে পড়ে তাই এ শাখা অফিসটি বন্ধ করে দিয়ে উত্তরা অফিসে চলে যাচ্ছি। সেখানে আমরা কার্যক্রম চালাব।
তিনি আরও বলেন, এ শাখায় আমাদের কিছু অনলাইন ক্লায়েন্ট আছে, তবে এখানে ভাড়া বেশি। সব খরচই বেশি। তাই চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরই মধ্যে ডিএসইর নিকুঞ্জ ভবন ছেড়ে চলে গেছে শাকো সিকিউরিটিজসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। শুধু তাই নয়, ভবনটি উদ্বোধনের পাঁচ বছর পরেও ফাঁকা পড়ে আছে ৮০টির বেশি ব্রোকারেজ হাউজ। অথচ বিলাসী ভবনটির বিদ্যুৎ বিলসহ বাৎসরিক খরচ মেটাতেই চলে যাচ্ছে প্রায় দেড়শ কোটি টাকা। হিসাব বলছে, ব্যবসা মন্দায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ডিএসইর আয় ৪৪ কোটি ১০ লাখ টাকা কমে নেমেছে ৮০ কোটি ৬০ লাখ টাকায়। ফলে সরকারও হারাচ্ছে বড় অঙ্কের রাজস্ব।
ডিএসইর বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য, ২০২১-২২ অর্থবছরের সংস্থাটির আয় এসেছে ৩২১ কোটি ৩০ লাখ টাকা, আর ব্যয় হয়েছে ১৪১ কোটি টাকা। ট্যাক্স পরিশোধের আগে তাদের নিট আয় থাকে ১৮০ কোটি ৩০ লাখ টাকা, আর ট্যাক্স পরিশোধের পর থাকে ১২৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। অন্যদিকে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ডিএসইর আয় ছিল ২৩৮ কোটি ২০ লাখ টাকা, ব্যয় ছিল ১৩১ কোটি ২০ লাখ টাকা। ট্যাক্স পরিশোধের আগে নিট আয় ১০৭ কোটি টাকা, আর ট্যাক্স পরিশোধের পর ৮০ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অর্থাৎ বছর ব্যবধানে ডিএসইর আয় কমেছে ৪৪ কোটি ১০ লাখ টাকা।
ব্রোকার্সদের সংগঠন ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, এতোদিন পর ডিএসইর এমন অবস্থা হবে, তা প্রত্যাশিত নয়। তারা নিজেরাই নিজেদেরকে স্বাধীন ভাবে না, স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। গুরুত্বপূর্ণ এমডি পদ খালি পড়ে থাকে। বর্তমান শেয়ার বাজারে যে অবস্থা তার দায় ডিএসই এড়াতে পারে না।
নিকুঞ্জ ভবনে এসেও কোনো পরিবর্তন নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, বরং এমন বিলাসী ভবন চালাতে হলে এখন প্রতিদিন অন্তত ৩ হাজার কোটি টাকার টার্নওভার দরকার। অথচ হাজার কোটিও লেনদেন ছাড়াতে পারছে না ডিএসই। এমন মন্দাবস্থায় আছে ব্রোকারেজ হাউজগুলোও। তারা ব্যয় মেটাতে না পেরে শাখা বন্ধ করে চলে যাচ্ছে।
এ বাস্তবতায় সবকিছু ছাপিয়ে ডিএসইর নিকুঞ্জ ভবনকে পুঁজিবাজারের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করাটাকেই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন ডিএসই চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে যে ক্রান্তিকাল চলছে, তার ঘা ডিএসইতেও লেগেছে। তবে এখান থেকে কীভাবে উত্তরণ ঘটানো যায়, সে বিষয়ে চেষ্টা চলছে জানিয়ে হাফিজ মুহাম্মদ বলেন, ‘দুই-একটি হাউজ চলে গেছে এটা ঠিক, তবে আবার নতুন করে অনেকে আসছেও। ব্রোকারেজ হাউজ বাদেও আমরা ভবনে অন্যান্য করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আশা করি, আমরা এ পরিস্থিতি থেকে শিগগিরই ঘুরে দাঁড়াতে পারব।’
এ বিষয়ে ডিএসইর সদস্য মিডওয়ে সিকিউরিটিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিকুর রহমান বলেন, ডিএসইর তিনটি শীর্ষ পদ দীর্ঘদিন ধরে ফাঁকা। বিকল্প লোক দিয়ে দীর্ঘদিন কাজ চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে, এতে কাজের গতি মন্থর হয়ে পড়ে। আর এমডি ও সিটিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদ, টেকনিক্যাল এসব পদে লোক না থাকলে যেকোনো সময় বড় সমস্যা হতে পারে। তখন উত্তরণের উপায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। ডিএসই একটি প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিষ্ঠান। এখানে হঠাৎ বড় কোনো সমস্যা হলে এর দায়ভার কে নেবে।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ বলেন, ডিএসইর এমডি পদটি বেতন ভাতার দিক দিয়ে আকর্ষণীয় হলেও প্রতিষ্ঠানটি কেন এ পদে লোক পাচ্ছে না, এটা একটা রহস্যময় বিষয়। এ পদে আগের ক্ষমতা সীমিত করা হয়েছে। পাশাপাশি ডিএসইর বোর্ড সদস্যদের সঙ্গে এ পদটির একটি দ্বন্দ্ব সব সময় থাকে। এ কারণে মনে হয় ডিএসইর এমডি পদটি শূন্য পড়ে আছে। বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন যেনতেনভাবে চলছে ডিএসই। যেকোনো সময় অঘটন ঘটলে রক্ষার উপায় নেই। তবে ডিএসই জানায়, শিগগিরই চূড়ান্ত হবে সবগুলো নিয়োগ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসইর এক পরিচালক বলেন, চীনের শেনঝেন স্টক এক্সচেঞ্জ ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ আমাদের পুঁজিবাজারের কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে যুক্ত হয়েছে অনেক দিন। আমরা আশা করেছিলাম, তারা এলে টেকনিক্যাল ও ফাইন্যান্সিয়াল সাপোর্ট পাব, কিন্তু তার কিছুই হয়নি।
সিটিওর নিয়োগ না হওয়া প্রসঙ্গে ডিএসইর চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. হাফিজ এম ডি হাসান বাবু বলেন, সিটিও পদটি টেকনিক্যাল একটি পদ। দীর্ঘদিন ধরে পদটি খালি আছে। একটি জটিল পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থ্যা বিএসইসি সিটিওকে অব্যাহতি দিয়েছে। সেই অবস্থায় আমরা দায়িত্ব নিয়েছি। আমরা পারলে এক সপ্তাহের মধ্যেই নতুন সিটিও নিয়োগ দিয়ে দিতাম। কিন্তু যোগ্য কাউকে না পাওয়ায় নিয়োগ দিতে পারিনি। তবে সিটিওর খোঁজ চলমান রয়েছে।’ চলতি বছরের জানুয়ারিতে চিফ অপারেটিং
অফিসার (সিওও) সাইফুর রহমান মজুমদার ডিএসই থেকে পদত্যাগ করেন। ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো ওই পদটি পূরণ করতে পারেনি ডিএসই। তিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে কর্মরত। গত ২০ মে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ড. এ টি এম তারিকুজ্জামান পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার হিসেবে যোগদান করায় প্রায় দেড় মাস ধরে ডিএসইর এমডি পদ ফাঁকা হয়। তবে এমডির জন্য গত মে মাসে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
এ নিয়ে ডিএসইর চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. হাফিজ এম ডি হাসান বাবু বলেন, যোগ্য লোকের অভাবে এতদিন পদগুলো খালি আছে। আমরা বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি; শিগগিরই শূন্য পদগুলো পূরণ হবে।