দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: গ্রাহকের অর্থ নিয়ে নয়ছয়ের অভিযোগ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বীমা খাতের কোম্পানি সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের কৌশলে ৫৪ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের এক নিরীক্ষায় বীমা কোম্পানিটির বিরুদ্ধে সরকারের ৫৪ লাখ টাকা ফাঁকির তথ্য বেরিয়ে এসেছে। যদিও প্রমাণিত হওয়ার পর কোম্পানিটি ফাঁকির টাকা পরিশোধ করেছে, তবে এখনো সুদের টাকা অপরিশোধিত রয়েছে।

এদিকে গ্রাহকের অর্থ নিয়ে নয়ছয়ের বিস্তর অভিযোগের কিছু চিত্র তুলে ধরা হলো: টাঙ্গাইল জেলায় সেলেনা আক্তার সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে ১০ বছর মেয়াদি একটি জীবন বিমা করেছিলেন। ২০২০ সালের দিকে তার বিমার একটি কিস্তি দেয়া বাকি ছিল। তবে ২০২০ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান।

সাড়ে চার বছর পার হয়ে গেলেও এখনো বিমা দাবির টাকা পাননি সেলেনা আক্তারের স্বামী হাসমত খান এবং তার ভাই মোহাম্মদ আসলাম হোসেন। শুধু সেলেনা আক্তারই নন। এমন হাজার হাজার গ্রাহকের অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না বেসরকারি বিমা প্রতিষ্ঠান সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। জীবন বিমা পলিসির মেয়াদ শেষ হলেও গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করতে পারছে না এ কোম্পানিটি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গ্রাহকের পাওনা অর্থ সানলাইফ কোম্পানি থেকে গ্রাহকদের ব্যাংক চেক ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। গ্রাহক সেই নির্ধারিত ব্যাংকে চেক জমা দিলে তাকে জানানো হচ্ছে অ্যাকাউন্টে টাকা নেই। এভাবে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির গ্রাহকরা।

সেলেনার ভাই মোহাম্মদ আসলাম হোসেন একাধিকবার সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে যোগাযোগ করলে বারবার টাকা ফেরতের আশ্বাস দেয়া হয়। মোহাম্মদ আসলাম হোসেন বলেন, সানলাইফ থেকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের একটি চেক দিয়েছে। তবে ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে এখনো টাকা আসেনি। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে টাকা দেয়ার নামে আমাকে ঘুরাচ্ছে। তিনি আরও জানান, তার বোন নিয়মিত কোম্পানিতে পলিসির টাকা পরিশোধ করেছেন। তবে কোম্পানিটি তার বোনের বিমা করার অর্থ পরিশোধ করছেন না।’

আইডিআরএর ২০২০ সালের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, করোনাভাইরাসের প্রভাবে সৃষ্ট অর্থসংকটে থাকা বিমা গ্রাহকদের সহযোগিতা করার স্বার্থে তাই মেয়াদোত্তীর্ণ পলিসিগুলোর বিপরীতে প্রাপ্য দাবি ৯০ দিনের পরিবর্তে ৩০ দিনের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের আবেদনের জন্য অপেক্ষা করা যাবে না। তথ্যভাণ্ডার থেকে মেয়াদোত্তীর্ণের তালিকা নিয়ে বিমা গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে কোম্পানিগুলোকেই। এরপর কোম্পানিগুলোকে অনলাইনে গ্রাহকের ব্যাংকে বিমা দাবির টাকা পরিশোধের ব্যবস্থা করতে হবে।

আইডিআরএর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, কোনো গ্রাহকের মৃত্যু হলে ৯০ দিনের মধ্যে বিমা কোম্পানিকে টাকা পরিশোধ করতে হবে। তবে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স এ নিয়ম অনুসরণ করছে না। কোম্পানিটির অবস্থাও ভালো নয়। সানলাইফের গ্রাহকরা হন্যে হয়ে টাকার জন্য ঘুরছেন।’
বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষে (আইডিআরএ) প্রায় ৬ হাজার গ্রাহকের অভিযোগ জমা পড়েছে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির নামে।

আইডিআরএর কর্মকর্তারা জানান, ৬ হাজার অভিযোগের সংখ্যা প্রকৃত চিত্র নয়। এর চেয়ে অনেক বেশি অভিযোগ রয়েছে যা আইডিআর পর্যন্ত আসে না। কারণ অনেক গ্রাহক আইডিআরএ সম্পর্কে অবহিত নন। ফলে এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি। জানা যায়, সাইলাইফ কোম্পানিটির প্রায় ৫০ কোটি টাকা বিমা দাবি অপরিশোধিত রয়েছে।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স্য ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৫৪ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। এই অনিয়ম ধরা পড়েছে ভ্যাট গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের নিরীক্ষায়। পরে ভ্যাট ফাঁকির অর্থ আদায় করতে উত্তর ভ্যাট কমিশনারেটে এই সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাঠায় ভ্যাট গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার মো. নেয়াজুর রহমান এই বিচারাদেশ দিয়েছেন।

ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনার স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, বনানীর বিটিএ টাওয়ারে অবস্থিত সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স্য কোম্পানি দুই বছরে ৫০ লাখ ২৯ হাজার ৭৫০ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। কোম্পানিটি দীর্ঘদিন ধরে ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে এলেও কোম্পানিটিকে ছাড় দিয়ে আসছিল উত্তর ভ্যাট কমিশনারেট। আর এই ভ্যাট পরিশোধ না করার জন্য দুই শতাংশ হারে জরিমানার বিধান রয়েছে।

নিয়ম অনুযায়ী কোনো প্রতিষ্ঠান ভ্যাট ফাঁকি দিলে উদ্ঘাটন থেকে পরিশোধের দিন পর্যন্ত ২ শতাংশ হারে জরিমানা দিতে হবে। সেই অনুযায়ী উত্তর ভ্যাট কমিশনারেট সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স্য কোম্পানিকে ২ শতাংশ হারে ২০২৩ সালের আদেশ জারি হওয়া পর্যন্ত সুদ আরোপ করা হয়েছে ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৮০১ টাকা। আর সব মিলে ৫৪ লাখ ৭৯ হাজার ৩৩২ টাকা।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, মূল ভ্যাট ফাঁকির সঙ্গে অক্টোবর ২০২৩ পর্যন্ত সময়ে সানলাইফের সুদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। সুদ সংক্রান্ত ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি সরকারের অনুকূলে জমা দিয়েছে। আরও সুদ বকেয়া রয়েছে ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা।

ভ্যাট কমিশনারের বিচারাদেশে বলা হয়েছে, সুদ ব্যতীত সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স্য কোম্পানির ভ্যাট ফাঁকি ৫০ লাখ ২৯ হাজার ৭৫০ টাকা। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে। আর সুদের টাকা আদায়যোগ্য বলেও বিচারাদেশ দিয়েছে উত্তর ভ্যাট কমিশনারেট। তবে এই রায়ে সংক্ষুব্ধ হলে প্রতিষ্ঠানটি আপিল করতে পারবে বলেও এই চিঠিতে বলা হয়েছে।