আলমগীর হোসেন ও মিজানুর রহমান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন পুঁজি করে দেশে বড় রকমের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হওয়ায় দুর্বৃত্তরা এবার ভিন্ন কৌশলে নাশকতা চালাতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন গোয়েন্দারা। ইতোমধ্যেই সারা দেশে পুলিশ সদস্যদের বিষয়টি অবহিত করে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

মুলত টানা কয়েকদিন ধরে চলা সহিংস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হলেও চোরাগোপ্তা হামলা অব্যাহত থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা। কারণ সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের চলা আন্দোলনের মধ্যে একদল দুষ্কৃতকারী সরকারি স্থাপনায় নজিরবিহীন তাণ্ডব চালিয়েছে।

যাত্রাবাড়ীতে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজায় আগুন দেওয়ার মাধ্যমে শুরু হওয়া এ তাণ্ডবে একে একে পুড়েছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বনানী ও মহাখালী টোলপ্লাজা, বিটিভি ভবন, সেতু ভবন, মেট্রোরেলের স্টেশন ফলে রক্ষা পায়নি ফায়ার সার্ভিসও। মিরপুর ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে হামলা চালানো হয়েছে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি। দুষ্কৃতকারীদের হামলায় আহত হয়েছেন ফায়ার ফাইটাররাও।

দুষ্কৃতকারীদের হাতে তাণ্ডবের শিকার হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়, মিরপুরের ইনডোর স্টেডিয়াম। বিআরটিএ ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মতো সরকারি স্থাপনায়ও তাণ্ডব চালিয়েছে দুষ্কৃতকারীরা। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে পুলিশ ফাঁড়ি ও ট্রাফিক বক্স। হামলা চালানো হয়েছে থানায়ও। স্বাধীন বাংলাদেশে এর আগে কখনো সরকারি স্থাপনায় এভাবে তাণ্ডব চালানো হয়নি।

শুধু রাজধানীতে নয়, দুষ্কৃতকারীরা তাণ্ডব চালিয়েছে ঢাকার বাইরেও। নরসিংদীতে জেলা কারাগার এবং পৌরসভা ও ইউনিয়ন কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়েছে। নরসিংদীতে কারাগার ভেঙে ৯ জন জঙ্গিসহ ৮২৬ বন্দি পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। নারায়ণগঞ্জে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, সিটি করপোরেশনের নগর ভবনে চালানো হয়েছে তাণ্ডব।

দৃষ্কৃতকারীদের তাণ্ডবে রাজধানীসহ সারাদেশে জনমনে সৃষ্টি হয় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। পরিস্থিতি সামাল দিতে একপর্যায়ে কারফিউ জারি করে সরকার। সেই সঙ্গে নামানো হয় সেনাবাহিনী। এতে অনেকটাই ঘরবন্দি হয়ে পড়েন মানুষ। প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে খুব একটা বের হননি। তবে সেনাবাহিনী রাস্তায় নামার পর অল্প সময়ের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। ফলে শিথিল করা হয় কারফিউ।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, দেশে গত কয়েকদিনে ভয়ংকর নাশকতা চালানো হয়েছে। এই নাশকতার পরিকল্পনা আরও বড় ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় তাতে বাধা পেলেও থেমে নেই নাশকতাকারীরা। ভিন্ন পন্থায় এবার তারা হামলার চেষ্টা করবে। গোয়েন্দারা তথ্য বিশ্লেষণ করে জানতে পেরেছেন, চোরাগোপ্তা হামলায় টার্গেট করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সরকারদলীয় নেতাকর্মী ও সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের। এই পরিকল্পনার সঙ্গে সরাসরি অন্তত চারটি রাজনৈতিক দলের নেতারা জড়িত। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসব দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের পর তাদের কাছে এই তথ্যগুলো পাওয়া গেছে।

চলমান অভিযানে গ্রেপ্তার কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র বলছে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সহিংসতা চালানোর পেছনে একাধিক রাজনৈতিক দল এবং তাদের ছাত্র সংগঠনগুলো সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। পরিকল্পনা প্রাথমিকভাবে বাস্তবায়ন করার পর একে অন্যকে অভিনন্দন জানিয়ে মেসেজ আদান-প্রদান করেছে। সরকারের পতনকে চূড়ান্ত লক্ষ্য নির্ধারণ করে এসব নাশকতার পরিকল্পনা করা হয়। তাদের পরিকল্পনায় চোরাগোপ্তা হামলার বিষয়টিও রয়েছে। এসব হামলা ঠেকাতে ইতোমধ্যে মাঠে নেমেছে পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা। তবে এই দলগুলোর সঙ্গে উগ্রবাদী কোনো সংগঠনের যোগাযাগ ছিল কি না—সে বিষয়েও তদন্ত শুরু হয়েছে।

পুলিশের সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলোর দায়িত্বশীলরা বলছেন, এর আগে বিভিন্ন সময়ে হওয়া আন্দোলনে রাজধানীকে বিচ্ছিন্ন করা যায়নি। তবে এবার পরিকল্পিতভাবেই ঢাকার চারটি প্রবেশপথ যাত্রাবাড়ী-পোস্তগোলা, মিরপুর, উত্তরা ও সাভার এলাকায় সহিংসতা সৃষ্টি করা হয়। টানা কয়েকদিনের সহিংসতায় এবার রাজধানী কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে এই হামলাগুলো হয়েছে। রাজধানীজুড়ে সহিংসতা চালানোর জন্য বিভিন্ন জেলা থেকে প্রশিক্ষিত ক্যাডারদের নিয়ে আসা হয়েছিল। যারা অন্তত দুই মাস আগে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ঢাকার চারপাশে অবস্থান নিয়ে নাশকতার ছক আঁকে।

দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, নাশকতার পরিকল্পনাকারীরা কোনো একটি আন্দোলনের অপেক্ষায় ছিল। ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে ঢুকে পরিস্থিতি সৃষ্টির পর বাকি ক্যাডারদের আগে থেকে ভাড়া করা বাসায় নিয়ে আসা হয়। সেখান থেকে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে সহিংসতা চালানো হয়।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, চোরাগোপ্তা হামলার মতো ঘটনা যেন না ঘটে, সেজন্য পুলিশের সব ইউনিটকে সতর্ক করা হয়েছে। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি পুলিশ সদস্যরা যেন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করে চলাফেরা করেন, সে ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তরে অপারেশন শাখার দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত আইজিপি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘সার্বিক বিষয় মাথায় রেখে আমরা নিরাপত্তা ব্যবস্থা সাজিয়েছি। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত পুলিশের সব সদস্যকে সতর্কভাবে চলাচলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘পুলিশ সদস্য, পুলিশের স্থাপনা, এমনকি পুলিশ সদস্যদের বাসা খুঁজে টার্গেট করে হামলা করেছে। মাইকিং করে পুলিশ সদস্যদের বাসা ভাড়া না দেওয়া, তাদের খুঁজে বের করে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। দুর্বৃত্তদের এ ধরনের তৎপরতা বিশ্লেষণ করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আমরা আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে তাদের একের পর এক চিহ্নিত করবো। তাদের আইনের মুখোমুখি করবো। এটা থেকে আমরা এক পাও সরে দাঁড়াবো না। তবে চোরাগোপ্তা হামলার মতো অনেক কিছুই হতে পারে। সব ঝুঁকি বিবেচনা করেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।