দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: গত দেড় বছরে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রাইম ব্যাংক ফাস্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ডের দর বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন গুণে। যদিও এই সময়ে পুঁজিবাজার নাজুক অবস্থার মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে। বিশেষ করে এই সময়ে মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতের ফান্ডগুলোর অবস্থা ক্রমশই খারাপের দিকে ছিল। তবুও প্রাইম ব্যাংক ফাস্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড নিয়ে চলছে কারসাজি। যদিও কারসাজি খালি চেখে দেখা গেলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেখে পড়ছে না।

অথচ কোম্পানি লোকসানে থাকলে শেয়ারের দর হু হু করে বাড়ছে। আর এ কারসাজির নেপথ্যে রয়েছে কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউজ। মুলত প্রাইম ফাইন্যান্স ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ডে তালিকাভুক্ত ৩৬টি কোম্পানির শেয়ারে সাড়ে ৩৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ১৬ কোটি টাকা লোকসান। আটটি মিউচুয়াল ফান্ডে ১ কোটি ৯২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে লোকসান ৮১ লাখ টাকা। একটি মাত্র বন্ডে বিনিয়োগ করেও পড়েছে লোকসানে। সব মিলিয়ে শেয়ারবাজারে ৩৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে লোকসান ১৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।

শেয়ার ব্যবসায় এভাবে ধরা খেলেও এক শ্রেণির বিনিয়োগকারীর কাছে এই মিউচুয়াল ফান্ডটি যেন টাকা বানানোর মেশিনে পরিণত হয়েছে। ফান্ডটির ইউনিটের দাম সম্প্রতি পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে। হু হু করে বেড়ে আট মাসে ফান্ডটির ইউনিটের দাম হয়েছে তিনগুণ। এভাবে দাম বাড়লেও এ নিয়ে কোনো সতর্কবার্তা প্রকাশ করেনি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কর্তৃপক্ষ।

তবে মিউচুয়াল ফান্ডটির দাম বাড়াকে অস্বাভাবিক বলছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। এমনকি মিউচুয়াল ফান্ডটি পরিচালনার দায়িত্ব পালন করা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি থেকেও এই দাম বাড়াকে অস্বাভাবিক বলা হচ্ছে। আর পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দাম বাড়ার পিছনে অস্বাভাবিক কিছু পাওয়া গেলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তালিকাভুক্ত সিংহভাগ মিউচুয়াল ফান্ড করুণ অবস্থার মধ্যে রয়েছে। ৩-৪ টাকাতেও কোনো কোনো মিউচুয়াল ফান্ড তেমন বিক্রি হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতি একটি মিউচুয়াল ফান্ডের দাম বেড়ে তিনগুণ হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক বিষয় হতে পারে না। তারা বলছেন, মিউচুয়াল ফান্ডের আয়ের প্রধান খাত পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ।

সাধারণত পুঁজিবাজার ভালো থাকলে মিউচুয়াল ফান্ড ভালো মুনাফা করতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজার খুব একটা ভালো ছিল না। ফলে মিউচুয়াল ফান্ডগুলোও ভালো ব্যবসা করতে পারেনি। প্রাইম ফাইন্যান্স ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ডের পোর্টফোলিও দেখলেই দেখা যাবে ফান্ডটি যেখানে বিনিয়োগ করেছে সেখানেই লোকসান। এ পরিস্থিতিতে দাম বাড়া কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারে না। এই দাম বাড়ার পিছনে কোনো বিশেষ গোষ্ঠী রয়েছে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ২২ নভেম্বর প্রাইম ফাইন্যান্স ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ডের প্রতিটি ইউনিটের দাম ছিল ১৪ টাকা ৪০ পয়সা। সেখান থেকে দফায় দফায় দাম বেড়ে এখন ৪৬ টাকা ৮০ পয়সায় উঠেছে। অর্থাৎ প্রতিটি ইউনিটের দাম বেড়েছে ৩২ টাকা ৪০ পয়সা বা ২৫৫ শতাংশ। অন্যভাবে বলা যায়, যদি কোনো বিনিয়োগকারী গত ২২ নভেম্বর প্রাইম ফাইন্যান্স ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ডের ১০ লাখ টাকার ইউনিট কেনেন, তাহলে এখন তার বাজারমূল্য ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ হিসেবে ১০ লাখ টাকা খাটিয়ে সাত মাসেই মুনাফা পাওয়া গেছে ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। যা রূপকথার ‘আলাদিনের চেরাগ’ পাওয়ার মতো ঘটনা!

এমন দাম বাড়া মিউচুয়াল ফান্ডটি গত এপ্রিলে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিন মাসের ব্যবসায় ফান্ডটির ইউনিট প্রতি লোকসান হয়েছে ১ টাকা ৯২ পয়সা। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে ইউনিট প্রতি মুনাফা হয় ৫ পয়সা।

আইসিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি পরিচালিত এ মিউচুয়াল ফান্ডটির পোর্টফোলিও পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ফান্ডটির পোর্টফোলিওতে ব্যাংক খাতের ছয়টি কোম্পানির শেয়ার রয়েছে। শেয়ারগুলোর ক্রয়মূল্য ৫ কোটি ১৮ লাখ টাকা। বিপরীতে বাজারমূল্য দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৯৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা। অর্থাৎ, ২ কোটি ২৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা আনরিয়েলাইজ লোকসান।

একইভাবে দুটি সিমেন্ট কোম্পানির শেয়ারে ৩ কোটি ৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে লোকসান ৮৫ লাখ টাকা, একটি সিরামিক কোম্পানিতে ২ কোটি ৩১ লাখ ৯০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে লোকসান ১ কোটি ১৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা, প্রকৌশল খাতের তিনটি কোম্পানিতে ৪ কোটি ৬৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে লোকসান ২ কোটি ৫৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং পাঁচটি লিজিং কোম্পানিতে ৪ কোটি ৪৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে লোকসান ৩ কোটি ৩১ লাখ ৮০ হাজার টাকা।

এছাড়া দুটি খাদ্য কোম্পানিতে ১ কোটি ৬৮ লাখ ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে ৮১ লাখ টাকা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চার কোম্পানিতে ৬ কোটি ৭৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে ২ কোটি ৯২ লাখ ১০ হাজার টাকা এবং পাঁচটি বিমা কোম্পানিতে ৮৭ লাখ ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে লোকসান ৩৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

আর বিবিধ খাতের একটি কোম্পানিতে ৩১ লাখ ৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে লোকসান ১ লাখ ২০ হাজার টাকা, দুটি ওষুধ কোম্পানিতে ১ কোটি ৯২ লাখ বিনিয়োগ করে ৫৭ লাখ ১০ হাজার টাকা, একটি টেলিকম কোম্পানিতে ৫৩ লাখ ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে ১০ লাখ টাকা এবং তিনটি বস্ত্র কোম্পানিতে ১ কোটি ৫৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে লোকসান ১ কোটি ১৯ লাখ ৩০ হাজার টাকা।

মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করেও বড় ধরনের লোকসানে পড়েছে এ ফান্ডটি। আটটি মিউচুয়াল ফান্ডে ১ কোটি ৯২ লাখ ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে ৮১ লাখ ৪০ হাজার টাকা লোকসানে পড়তে হয়েছে। সব মিলিয়ে পুঁজিবাজারে ৩৫ কোটি ৯৯ লাখ ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগে লোকসান দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ৯৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা। অর্থাৎ বিনিয়োগ করা অর্থের প্রায় অর্ধেক নেই হয়ে গেছে ফান্ডটির।

ডিএসই’র এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মিউচুয়াল ফান্ডের বিনিয়োগের প্রধান খাত পুঁজিবাজার। মোট বিনিয়োগের ৭৫ শতাংশই পুঁজিবাজারে করতে হয়। সুতরাং, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে যে মিউচুয়াল ফান্ড প্রায় ৫০ শতাংশ লোকসানে, সেই মিউচুয়াল ফান্ডের দাম বেড়ে তিনগুণ হয়ে যাওয়া কিছুতেই স্বাভাবিক না। এই দাম বাড়ার পিছনে কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর হাত রয়েছে, এমনটা সন্দেহ করাই স্বাভাবিক। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত বিষয়টি খতিয়ে দেখা।

যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘প্রাইম ফাইন্যান্স ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ডটির দাম বাড়ার বিষয়টি সার্ভিলেন্স থেকে মনিটরিং করা হবে। যদি দাম বাড়ার ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক কিছু পাওয়া যায়, তাহলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’