ড. ইউনূসের ছোঁয়ায় পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন আস্থার সৃষ্টি
তৌফিক ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: শেখ হাসিনা সরকারের পতন পর থেকে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন। পুঁজিবাজারে আবারও সুদিন ফিরে আসবে এই আশায় বুক বাধছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। যার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে গত তিন কার্যদিবসে পুঁজিবাজারে লেনদেন ও মূল্য সূচক বাড়ার মাধ্যমেই। গত আড়াই বছর যাবত দেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের চোখেমুখে ছিল কেবল আতঙ্কের ছাপ। কিছু কারসাজিকারী ছাড়া পুঁজিবাজারে লাভবান হয়েছেন, এমন বিনিয়োগকারী খুঁজে পাওয়া খুবই দুস্কর হবে।
কিন্তু সব বাধা পেরিয়ে এখন পুঁজিবাজার ভরসার জায়গা হয়ে উঠছে বিনিয়োগকারীদের জন্য। ফলে গত তিন কার্যদিবসে ডিএসইর সূচক বেড়েছে ৬৯৩ পয়েন্ট। এটি বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ইতিহাসে নতুন রেকর্ড। এর আগে এই রকম টানা তিন দিনের উত্থানে ডিএসই সূচকের এমন উত্থান হয়নি।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের খবরে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন করে আস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ড. ইউনূসের প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর আকুন্ঠ আস্থার কারণেই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এমন আস্থার ভিত তৈরি হয়েছে বলে বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
কারণ গত আড়াই বছরে লাগামহীন পতনে দেশের পুঁজিবাজার তলালিতে নেমে গিয়েছিল। দীর্ঘদিনের ঘুনে ধরা পুঁজিবাজার এখন বিশাল শক্তিমত্তা নিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তাঁরা আশা করছেন ড. ইউনূসের ছোঁয়ায় দেশের পুঁজিবাজার নতুন উচ্চতার দিকে অগ্রসর হবে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে দেশের পুঁজিবাজারে সুশাসন ছিল না। নিয়ন্ত্রক সংস্থা নানাভাবে বাজারে অযাচিত হস্তক্ষেপ করেছে। তাতে আরও বেড়েছে বাজারের সংকট। একই সঙ্গে একের পর এক দুর্বল কোম্পানি তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এখন সরকার পতনের পর সবকিছু নতুন করে সাজানো হচ্ছে। তাতে পুঁজিবাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ছে এবং বাজার ভালো হবে সেই প্রত্যাশা বিনিয়োগকারীদের মনে জেগেছে। তারই প্রতিফলন এখন বাজারে।
তারা আরো বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই বাজার পতনের মধ্যে থাকায় ভালো ভালো কোম্পানির শেয়ার দাম অনেক কমে গেছে। এখন বাজারে ভালো কোম্পানির শেয়ার দাম বাড়ার প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। এটা খুব ভালো লক্ষণ। একই সঙ্গে লেনদেনের গতি বাড়ছে। এতে বিষয়টি স্পষ্ট যে, বাজারে বিনিয়োগকারীরা সক্রিয় এবং নতুন বিনিয়োগ আসছে। বাজারে এখন সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। বন্ধ করতে হবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অযাচিত হস্তক্ষেপ।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২২ সালের ২০ জানুয়ারি ডিএসইর প্রধান সূচক ছিল ৭ হাজার ১০৫ পয়েন্ট। এরপর থেকেই চলেছে থেমে থেমে পতনের ছোবল। পতনের ছোবলে ২ বছর ৭ মাসে ডিএসইর সূচক কমেছে প্রায় ২ হাজার পয়েন্ট। অথচ এর মধ্যে পুঁজিবাজারে নতুন আইপিও শেয়ার এসেছে ২০টির বেশি। যেগুলোর মূলধন সূচকে যোগ হয়েছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সময়ে বাজারে তারল্য সংকটের কারণে যতটা কমেছে, তারচেয়ে বেশি কমেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে। অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত ইসলামের সহযোগিতায় আওয়ামী পন্থীদের লুটপাটে পুঁজিবাজারের মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেছে। ফলে শিবলী রুবাইয়াত ও তার আওয়ামী পন্থী দোসরদের দুর্নীতি ও অনিয়মের তদন্ত দাবি করেছেন তারা। পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে অবিলম্বে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান ও কমিশন সদস্যদের পূর্নগঠন করা প্রয়োজন।
নোবেলবিজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনূস অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান হওয়ার খবরে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের নতুন করে আস্থা তৈরি হচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলোর পূর্ণ সমর্থন পাওয়া ড. ইউনূসের নেতৃত্বে দেশের অর্থনীতিতে নতুন গতি ফিরবে এমনটাই সবার বিশ্বাস।
বাজারের এই চিত্র সম্পর্কে ডিএসইর এক সদস্য বলেন, গত কয়েক বছরে ধরে পুঁজিবাজারে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিভিন্ন সময় অযাচিত হস্তক্ষেপ করে কারসাজিকারীদের পুঁজিবাজার থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। কারসাজিকারীদের সুযোগ করে দিতেই ফ্লোর প্রাইস (দাম কমার সর্বনিম্ন সীমা) বেঁধে দিয়ে দীর্ঘদিন বাজার আটকে রাখা হয়। বিভিন্ন পক্ষের সমালোচনার কারণে এক পর্যায়ে ফ্লোর প্রাইস তুলে নিলেও পরবর্তীসময়ে দাম কমার ক্ষেত্রে সার্কিট ব্রেকারের নিয়মে পরিবর্তন আনা হয়। এটিও কারসাজিকারীদের সুযোগ কেরে দিতে করা হয়। ফলে বাজারের ওপর থেকে বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়।
তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে পুঁজিবাজার পতনের মধ্যে পড়ে। এখন সরকার পতন হওয়ায় পুঁজিবাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছে। তারা আশা করছেন বাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে। একই সঙ্গে ভালো ভালো কোম্পানি বাজারে আসবে। সেই আশায় বিনিয়োগকারীরা বাজারে নতুন করে বিনিয়োগ করছেন। ফলে দীর্ঘ মন্দা কেটে বাজার সুদিনে ফেরার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এদিকে গত সপ্তাহে সূচকের উত্থানে টাকার পরিমাণে লেনদেনও বেড়েছে। সপ্তাহটিতে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দর বেড়েছে। সপ্তাহটিতে ৫০ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা বাজার মূলধন যোগ হয়েছে। ডিএসই সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। জানা গেছে বিদায়ী সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস লেনদেন শুরুর আগে ডিএসইতে বাজার মূলধন ছিল ৬ লাখ ৫৩ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা।
যা সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস লেনদেন শেষে দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৩ হাজার ৯১৩ কোটি টাকায়। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে বাজার মূলধন ৫০ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা বেড়েছে। বিদায়ী সপ্তাহে ডিএসইতে ৩ হাজার ৩৩৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। আগের সপ্তাহে হয়েছিল ২ হাজার ৩৯৪ কোটি ৬০ লাখ টাকার। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে ডিএসইতে লেনদেন ৯৪৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা বেড়েছে।
সপ্তাহের ব্যবধানে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫৯০ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৯২৪ পয়েন্টে। অপর সূচকগুলোর মধ্যে ডিএসই শরিয়াহ সূচক ১০৯ পয়েন্ট এবং ডিএসই-৩০ সূচক ২৩১ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১ হাজার ২৭৪ পয়েন্টে এবং ২ হাজার ১৩২ পয়েন্টে। বিদায়ী সপ্তাহে ডিএসইতে মোট ৩৯৭ টি প্রতিষ্ঠান শেয়ার ও ইউনিট লেনদেনে অংশ নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দর বেড়েছে ৩৩৯ টির, কমেছে ৪৭ টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ১১ টির শতাংশের শেয়ার ও ইউনিট দর।