দীর্ঘ দেড় যুগ পর তিন ইস্যুতে ফুরফুরে মেজাজে বিএনপি
আলমগীর হোসেন ও শফিকুল ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ক্ষমতার লাগাম ছুটে যাওয়ার পর থেকেই কঠিন দুই দশক পার করেছে রাজনীতির মাঠের কঠিন মিত্র বিএনপি-জামায়াত ও তাদের অন্যান্য জোটসঙ্গীরা। শত চেষ্টায় বিপদ কাটাতে না পারলেও এবার আকস্মিক এক গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে দীর্ঘদিনের দুই মিত্রকে ক্ষমতার কাছাকাছি এনে দিয়েছে ছাত্র-জনতা। গত বৃহস্পতিবার বঙ্গভবনে শান্তিকে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে শপথ বাক্য পাঠ করানো হয়।
সেখানে বেশ খোশ মেজাজে দেখা যায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমানসহ এতদিন বিরোধী জোটে থাকা নেতাদের। এছাড়া বৈষম্যের বিলোপ ও সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের নাম করে ছাত্র-নাগরিকের ৩৫ দিনের আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন টানা চতুর্থ মেয়াদে দেশ পরিচালনায় থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার মাত্র ৪দিন আগে তার রাজনীতির প্রধান নিশানা জামায়াত ইসলামীকে নির্বাহী আদেশে ‘সন্ত্রাসী সত্তা’ হিসাবে নিষিদ্ধ করেছিলেন। তবে সরকার বিরোধী তীব্র আন্দোলন চলতে থাকলেও জামায়াতও রাজপথে সক্রিয় হয়। ফলে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর টানা চারদিন সরকারবিহীন ছিল বাংলাদেশ; ইউনূসের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে দেশে এখন অরাজনৈতিক অন্তর্র্বতীকালীন সরকার বিরাজ করছে।
এই পরিস্থিতিতেও বঙ্গভবনে আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর মুখে ছিল বাঁধভাঙা আনন্দ আর উচ্ছ্বাস। অন্যদিকে দলীয় রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত শপথে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের কোনো প্রতিনিধিই উপস্থিত ছিলেন না। অভ্যুত্থান পরবর্তী অরাজকতা ও প্রতিশোধমূলক আক্রমণের ভয়ে আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতাই গেছেন আত্মগোপনে। মন্ত্রী- সংসদ সদস্যদের অনেকেই গোপনে দেশ ছেড়েছেন।
এর মধ্যে দুর্নীতির দুই মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত দলীয় প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি, প্রায় দেড় যুগ পর গত বুধবার বাধাহীনভাবে সমাবেশ এবং সেই সমাবেশে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্যের সুযোগ তৈরি হওয়ায় বিএনপি নেতারা বেশ ফুরফুরে মেজাজে রয়েছেন। প্রায় দেড় যুগ পর বিএনপি এসব সুযোগ পেলেও শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্র্বতী সরকারের মেয়াদ তিন মাসের বেশি চায় না। দলটির নেতারা ইতোমধ্যে আগামী তিন মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের জোর দাবি জানিয়েছেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর দেশের পরিস্থিতি অনুকূলে রয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
এদিকে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারকে অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি সব ধরনের সহযোগিতা করার কথাও জানিয়েছে দলটি। বিএনপি নেতারা বলছেন, ছাত্র-জনতার সর্বাত্মক গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের পতন ঘটে গত ৫ আগস্ট। এখন দেশের পরিবর্তনের জন্য অন্তর্র্বতীকালীন সরকার কাজ করবে। তারা ছাত্রদের দাবি পূরণে সবার সঙ্গে আলোচনা করে একটি রূপরেখা মধ্য দিয়ে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী একটি পার্লামেন্ট তৈরি করতে সক্ষম হবে। সরকার নিয়ে যেন জনগণের মনে কোনো প্রশ্ন তৈরি না হয় এটাই প্রত্যাশা করছি। একই সঙ্গে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে বলে আশা করছি।
বিএনপি মনে করে, স্বাধীন বাংলাদেশে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে নতুন অন্তর্র্বতীকালীন সরকার মনোযোগ দিয়ে কাজ করবে এবং সফল হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্র্বতীকালীন সরকার পরিচালনায় সফল হবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এদিকে গত বুধবার ঢাকায় এক সমাবেশে নেতাকর্মীসহ জনগণের উদ্দেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, আপনারা নৈরাজ্য শক্ত হাতে প্রতিরোধ করুন।
জানা গেছে, প্রায় দেড় যুগ পর গত বুধবার রাজধানীর নয়াপল্টনে বাধাহীনভাবে সমাবেশ করেছে বিএনপি। লাখো জনতার উপস্থিতিতে সমাবেশ করে দলটি। এদিকে সাড়ে ছয় বছর পর বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে ভার্চুয়াল এই জনসমাবেশে বক্তব্য দেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এ ছাড়া সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে লন্ডন থেকে স্কাইপেতে বক্তব্য দেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এতে অনেকটাই উজ্জীবিত দলটির সব পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।
ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসন অবসানের পর নির্বাচন আয়োজনের প্রয়োজনে গত বৃহস্পতিবার দায়িত্ব নেয় নতুন অন্তর্র্বতীকালীন সরকার। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে এই সরকারের নেতৃত্বে আছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস। অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের কাছে বিএনপিসহ অন্য বিরোধীদের চাওয়া দ্রুত নির্বাচন দেয়া।
যদিও এখনই আলোচনা হচ্ছে এই সরকারের নতুন নির্বাচন আয়োজনে সময় লাগবে। কারণ হিসেবে দেশের আইনশৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়কে সামনে আনা হচ্ছে। শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের ফলে এসব ব্যবস্থা অনেকটা ভেঙে পড়েছে। তাই রাষ্ট্র মেরামতে নতুন সরকারের কিছুটা সময় লাগবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করাও রাষ্ট্র মেরামতে সময় লাগবে বলে অভিমত পোষণ করেন।
অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠনের জন্য অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার সহযোগী উপদেষ্টাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গত শুক্রবার এক বিবৃতিতে তিনি অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, স্বৈরাচারী শাসনের পতনের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণ এখন অন্তর্র্বতী সরকারের কাছে এমন একটি পরিবেশ চায়, যেখানে তারা তাদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে এবং সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারে বলে প্রত্যাশা করে।
বিএনপি একটি পাবলিক ম্যান্ডেটসহ একটি নির্বাচিত সরকার গঠন এবং জনগণের সেবা করে একটি জবাবদিহিমূলক সংসদ, জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার এবং এর ফলে আইনের শাসন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠাকে সমর্থন করে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত কয়েক দিন জোরালোভাবে বলেছেন, দ্রুত অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠন করে তিন মাসের মধ্যে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে। যদিও এর কারণ ব্যাখ্যা করতে চাননি তিনি। তবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমাদের চাওয়া থাকবে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় চূড়ান্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থনীতি সচল রাখার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘ছাত্র-জনতার সর্বাত্মক গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ও তার সরকারের পতন ঘটে গত ৫ আগস্ট। এখন দেশের পরিবর্তনের জন্য অন্তর্র্বতীকালীন সরকার কাজ করবে। শেখ হাসিনা যেভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলা, বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে, লুটপাট করে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। এ অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়তেই এই সরকার কাজ করবে।’ তিনি বলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে কারও মনে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশেও নেই বাইরেও নেই, এটা তো হবেই। এ জন্যই বাংলাদেশে আন্দোলন হয়েছে, রক্ত দিয়েছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান বলেন, ‘আমি মনে করি ছাত্র-জনতার যে প্রত্যাশা তা পূরণের জন্য যা যা করার প্রয়োজন এই অন্তর্র্বতীকালীন সরকার তাই করবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ঢেলে সাজানোর জন্য কাজ করবে। যত দ্রুত নির্বাচন দেয়া যায় ততই ভালো। ছাত্রদের দাবি পূরণে সবার সঙ্গে আলোচনা করে একটি রূপরেখা তৈরি করতে সক্ষম হবে। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী একটি পার্লামেন্ট তৈরি করবে। সরকার নিয়ে যেন জনগণের মনে কোনো প্রশ্ন তৈরি না হয় এটাই প্রত্যাশা করছি।’