দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। ফলে দেশের পুঁজিবাজারে ধারাবাহিকভাবে কমছে বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা। গত কয়েক মাস ধরে বিদেশিদের পুঁজিবাজার ছাড়ার যে ধারা চলছে তা এখনো থামেনি। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ১৪ কার্যদিবসে বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাব কমেছে ৩১টি। আর গত তিন মাসে কমেছে ৮ হাজারের বেশি। এ কারণে শেয়ার বাজারে বিদেশি বিনিয়োগ অর্থাৎ পোর্টফোলিও বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্য বলছে, সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরের ৮ মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) প্রায় ৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ পুঁজি তুলে নিয়ে গেছে বিদেশিরা। বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার এ পরিমাণ আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডলার বেশি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মহামারি, যুদ্ধের কারণে যে বৈশ্বিক অস্থিরতা বিরাজ করছে, তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের পুঁজিবাজারে। ডলার সংকট, স্থানীয় মুদ্রার মান কমে যাওয়ার কারণেও বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। মুলত পুঁজিবাজারে বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা কমলেও হাসিনা সরকার পতনের পর স্থানীয় তথা দেশি বিনিয়োগকারীদের সংখ্যাও বাড়তে দেখা যাচ্ছে। শেষ ১৪ কার্যদিবসে স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাবে বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার। অবশ্য তিন মাস আগের তুলনায় বর্তমানে পুঁজিবাজারে ১ লাখের বেশি বিও হিসাব কম রয়েছে।

সিডিবিএলের তথ্যানুযায়ী, ২৫ আগস্ট শেষে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৭৩ হাজার ৫৫২টি। যা হাসিনা সরকার পতনের সময় ছিল ১৬ লাখ ৬৮ হাজার ৫৮টি। এ হিসাবে হাসিনা সরকার পতনের পর শেয়ারবাজারে বিও হিসাব বেড়েছে ৪ হাজার ৪৯৪টি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পড়ে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। পদত্যাগ করে তিনি দেশে ছেড়ে পালিয়ে যান। সরকার পতনের পর এখনো পর্যন্ত ১৪টি কার্যদিবস পার হয়েছে। এ সময়ে পুঁজিবাজারে বড় ধরনের উত্থান-পতন হলেও বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বাড়তে দেখা যাচ্ছে। অবশ্য সার্বিকভাবে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বাড়লেও, বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীর সংখ্যা কমতে দেখা যাচ্ছে।

সিডিবিএলের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব আছে ৪৭ হাজার ৩৩টি। হাসিনা সরকার পতনের সময় এ সংখ্যা ছিল ৪৭ হাজার ৮৪টি। অর্থাৎ গত ১৪ কার্যদিবসে বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব কমেছে ৫১টি। বিদেশিদের বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ছাড়ার এ প্রবণতা চলছে আরও আগে থেকেই। মাত্র তিন মাসের মধ্যে বিদেশি ও প্রবাসীদের বিও হিসাবে কমেছে ৮ হাজারের ওপরে। চলতি বছরের মে মাস শেষে বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের নামে বিও হিসাব ছিল ৫৫ হাজার ৪৫টি। এ হিসাবে গত তিন মাসে বিদেশি ও প্রবাসীদের বিও হিসাব কমেছে ৮ হাজার ১২টি।

বিদেশিদের পুঁজিবাজার ছাড়ার প্রবণতা অব্যাহত থাকলেও সরকার পতনের পর স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বাড়তে দেখা যাচ্ছে। সিডিবিএলের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশি বিনিয়োগকারীদের নামে বিও হিসাব আছে ১৬ লাখ ৯ হাজার ৩১২টি। যা হাসিনা সরকার পতনের সময় ছিল ১৬ লাখ ৩ হাজার ৮২২টি। অর্থাৎ দেশি বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব বেড়েছে ৫ হাজার ৪৯০টি। হাসিনা সরকারের পতনের পর পুঁজিবাজারে স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বাড়তে দেখা গেলেও তার আগে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজার ছেড়েছেন। তিন মাস আগে বা গত মে মাস শেষে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব ছিল ১৭ লাখ ৯১ হাজার ২২৮টি। আর বর্তমানে বিও হিসাব আছে ১৬ লাখ ৭৩ হাজার ৫৫২টি। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে বিও হিসাব কমেছে ১ লাখ ১৭ হাজার ৬৭৬টি।

এদিকে বর্তমানে পুঁজিবাজারে যে বিনিয়োগকারীরা আছেন, তার মধ্যে পুরুষ বিনিয়োগকারীদের নামে বিও হিসাব আছে ১২ লাখ ৫৩ হাজার ৪৮৬টি। হাসিনা সরকার পতনের সময় এ সংখ্যা ছিল ১২ লাখ ৪৮ হাজার ৪৩৪টি। অর্থাৎ হাসিনা সরকার পতনের পর পুরুষ বিনিয়োগকারীদের হিসাব বেড়েছে ৫ হাজার ৫২টি। অপরদিকে বর্তমানে নারী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব দাঁড়িছে ৪ লাখ ২ হাজার ৮৫৯টি। হাসিনা সরকার পতনের সময় এ সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ২ হাজার ৪৭২টি। এ হিসাবে হাসিনা সরকার পতনের পর ১৪ কার্যদিবসে নারী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব বেড়েছে ৩৮৭টি।

হাসিনা সরকার পতনের পর নারী ও পুরুষ বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি কোম্পানির বিও হিসাবও বেড়েছে। বর্তমানে কোম্পানি বিও হিসাব রয়েছে ১৭ হাজার ২০৭টি। হাসিনা সরকার পতনের সময় এ সংখ্যা ছিল ১৭ হাজার ১৫২টি। সে হিসেবে গত ১৪ কার্যদিবসে কোম্পানি বিও হিসাব বেড়েছে ৫৫টি। বর্তমানে বিনিয়োগকারীদের যে বিও হিসাব আছে তার মধ্যে একক নামে আছে ১১ লাখ ৮৯ হাজার ৭৫৯টি, যা হাসিনা সরকার পতনের সময় ছিল ১১ লাখ ৮৩ হাজার ৬৭৭টি। অর্থাৎ গত ১৪ কার্যদিবসে একক নামে বিও হিসাবে বেড়েছে ৬ হজার ৮২টি। অ

পরদিকে, বিনিয়োগকারীদের যৌথ নামে বিও হিসাব আছে ৪ লাখ ৬৬ হাজার ৫৮৬টি। হাসিনা সরকার পতনের সময় যৌথ বিও হিসাব ছিল ৪ লাখ ৬৭ হাজার ২২৯টি। অর্থাৎ গত ১৪ কার্যদিবসে যৌথ বিও হিসাব কমেছে ৬৪৩টি।
এদিকে পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭ সালে শেষবারের মতো দেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বেড়েছিল। ওই বছর বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিওতে কেনা শেয়ারের মূল্য ছিল ৬৫৭৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা। বিপরীতে বিক্রি করা শেয়ারের মূল্য ছিল ৪৮৭১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।

অর্থাৎ, ওই বছর বিদেশি পোর্টফোলিওতে নতুন করে বিনিয়োগ হয়েছিল ১৭০৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। আর সে বছর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) বিদেশি বিনিয়োগকারীদের লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৪৪৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা । পরের বছর অর্থাৎ ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে বিদেশিরা বিনিয়োগ উত্তোলনই করেছেন ক্রমবর্ধমান হারে। ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে বিনিয়োগ অল্প অল্প করে কমলেও ২০২০, ২১ এবং ২২ সালে উত্তোলনের হিড়িক লেগেছিল।

বিদেশি বিনিয়োগের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৮ সালে বিদেশিরা কিনেছেন ৪ হাজার ২৫০ কোটি ১৪ লাখ টাকার শেয়ার, বিপরীতে বিক্রি করেছেন ৪৭৪১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা শেয়ার। অর্থাৎ এ সময় বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ৪৯১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। বিনিয়োগ উত্তোলনের এ ধীরগতি অব্যাহত ছিল পরের বছর পর্যন্ত। ২০১৯ সালে বিদেশিরা শেয়ার কিনেছেন ৩৬৭৮ কোটি ৬৪ লাখ টাকার, বিপরীতে বিক্রি করেছেন ৪১৬৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। অর্থাৎ, ২০১৯ সালে পুঁজিবাজার থেকে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ৪৮৮ কোটি ১৬ লাখ টাকা।

কিন্তু ২০২০, ২১ এবং ২২ সালে দ্রুত কমেছে বিদেশি বিনিয়োগ। ২০২০ সালের হিসাব বলছে, ওই সময়ে বিদেশিরা ৩৮৯০ কোটি ৭৭ লাখ টাকার শেয়ার কেনার বিপরীতে বিক্রি করেছেন ৬৪৯৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। তার মানে ওই বছর বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ২৬০৬ কোটি ১০ লাখ টাকা। বিনিয়োগ কমার এ হার আগের বছরের চেয়ে পাঁচগুণের বেশি। ২০২১ সালেও আগের বছরের ধারায় লেনদেন হয়েছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিওতে। ওই বছর বিদেশিরা ২৪১৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকার শেয়ার কেনার বিপরীতে বিক্রি করেছেন ৪৯৪৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকার। অর্থাৎ, ২০২১-এ বিদেশিদের বিনিয়োগ কমেছে ২৫৩৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা।

আর সদ্য সমাপ্ত ২০২২ সালে বিদেশিরা কিনেছেন ১ হাজার ১৫৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকার শেয়ার, বিপরীতে বিক্রি করেছেন ৩ হাজার ১৯ কোটি ১৭ লাখ টাকার শেয়ার। অর্থাৎ নিট বিনিয়োগ কমেছে ১ হাজার ৮৬৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। চলতি বছর বিদেশি পোর্টফোলিওতে লেনদেন হয়েছে ৪ হাজার ১৭৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা; যা ২০১৭ সালের লেনদেনের সাড়ে ৩৬ শতাংশ। ২০১৮ থেকে ২০২২ সালে হিসাব সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ পর্যন্ত বিদেশিরা শেয়ার কিনেছেন ১৫৩৮৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকার, বিপরীতে বিক্রি করেছেন ২৩৩৭৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকার। এ সময় দেশের প্রধান স্টক এক্সচেঞ্জ ডিএসই থেকে ৭৯৮৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকার বিনিয়োগ প্রত্যাহার হয়েছে।