দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ১৯৮৩ সালে যাত্রা শুরু করে প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি খাতের ব্যাংক আইএফআইসি। জাতীয় নির্বাচন এলেই ব্যাংকটির কার্যক্রমে অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ করা যেত। গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র এক বছর বয়সী পাঁচ কোম্পানিকে ব্যাংকটি ঋণ দিয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে কোম্পানিগুলোর ঋণসীমা বৃদ্ধি করে ব্যাংকটি। অথচ এসব কোম্পানির নেই কোনো ওয়েবসাইট। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকে দেওয়া প্রতিবেদনেও দেওয়া হয়নি কোনো ঠিকানা।

এসব ঋণের সুবিধাভোগী হিসেবে মনে করা হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে। ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ অডিটের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আইএফআইসি ব্যাংকের ফেডারেশন ও প্রিন্সিপাল শাখা পাঁচটি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে ২ হাজার ৩৭৫ কোটির ঋণ বিতরণ করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে, ব্রাইটস্টার বিজনেস লিমিটেড, অ্যালট্রন ট্রেডিং লিমিটেড, ফারইস্ট বিজনেস লিমিটেড, সানস্টার বিজনেস লিমিটেড ও কসমস কমোডিটিস।

অনুসন্ধানে দেখা যায় যে, ব্যাংকটির ফেডারেশন শাখার গ্রাহক ব্রাইটস্টার বিজনেস লিমিটেড ২০২২ সালের ২৭ জুলাই কথিত ব্যবসা শুরু করেছে। একই শাখার অন্য গ্রাহক অ্যালট্রন ট্রেডিং লিমিটেড প্রায় একই সময়ে ব্যবসা শুরু করে। নামসর্বস্ব এ দুটি কোম্পানির কোনো ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা ছাড়াই দ্রুততার সঙ্গে হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ব্রাইটস্টারকে হিসাব খোলার মাত্র ২০ দিনে ৮৫ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়।

অন্য কোম্পানি অ্যালট্রনকে হিসাব খোলার ২৭ দিনের মাথায় ৯৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়। ঋণ অনুমোদন করার পরপরই দ্রুততার সঙ্গে ঋণের টাকা ছাড়ও করা হয়। এরপর ২০২৩ সালে আগস্ট পর্যন্ত অ্যালট্রনের ঋণ বৃদ্ধি হয়ে দাঁড়ায় ৪৪৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে এই দুই প্রতিষ্ঠানের ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০৭ কোটি টাকা।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ব্রাইটস্টার করপোরেশন নামে একটি গ্রুপ অব কোম্পানিজ রয়েছে। ব্রাইটস্টার বিজনেস তাদের প্রতিষ্ঠান কি না জানতে চাইলে তারা বলেছেন, এটি তাদের প্রতিষ্ঠান নয়। এ ছাড়া রাজধানীর পল্টন এলাকায় ব্রাইটস্টার নামে ২০১৪ সালের ঘর সাজানোর (ইন্টেরিয়র ডিজাইন) একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও সেটি অল্প দিনের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিষ্ঠানটির ওই সময়ের কর্মকর্তা মো. সেলিমুল্লাহ বলেছেন, বর্তমানে তাদের কোনো কার্যক্রম নেই।

জানতে চাইলে আইএফআইসি ব্যাংকের ফেডারেশন শাখার প্রধান ব্যবস্থাপক তাসলিমা আকতার বলেন, ঋণ আমরা সব ধরনের নিয়মকানুন মেনেই দিয়েছি। ঋণের অনুমোদন তো আর শাখা থেকে করা হয় না। এটা বোর্ডের কাজ। তবে শাখা থেকে আমাদের যেসব দায়িত্ব ছিল, সেগুলো পালন করেছি। এর বাইরে কোনো তথ্য আপনাকে দিতে পারবে না। দেশ প্রতিক্ষণের কাছে থাকা প্রতিষ্ঠান দুটির ঠিকানায় কোনো প্রতিষ্ঠান পাওয়া যায়নি জানালে তিনি বলেন, আপনাদের কাছে যেই ঠিকানা আছে সেটা সঠিক নয়। অথচ তাদের সঠিক ঠিকানা দিতেও অপারগতা প্রকাশ করেন এই কর্মকর্তা।

এদিকে, আরও তিনটি কোম্পানিকে আইএফআইসি ব্যাংকের প্রিন্সিপল শাখা ১ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে ফারইস্ট বিজনেস লিমিটেড নামের অন্য কোম্পানির ব্যবসা শুরু করার তারিখ দেখানো হয় ২০২২ সালের জুন মাসে। কোম্পানিটি কী পণ্যের ব্যবসা করে, তাও উল্লেখ করা হয়নি। এ কোম্পানিকে ৬১৪ কোটির ঋণ দেওয়া হয়েছে। একই ধরনের অন্য কোম্পানি সানস্টার বিজনেস লিমিটেড ব্যবসা শুরু করেছে ২০২২ সালের জুন মাসে। এ কোম্পানিকে ৬১৫ কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয়েছে।

একই সময়ে ব্যবসা শুরু করা কসমস কমোডিটিসকে দেওয়া হয়েছে ৬১২ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে পাঁচটি কোম্পানিকে অল্প সময়ের মধ্যে ২ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে, যাকে অবিশ্বাস্য বলছেন ব্যাংকিং খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। জানতে চাইলে আইএফআইসি ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা তো ইচ্ছা করলেই সব কিছু করতে পারি না। এখানে অনেকের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় জড়িত আছে। এ বিষয়ে কিছু বলে বিপদে পড়তে চাই না।’ এই ঋণের পুরোটাই দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি ব্যবসায়িক গ্রুপের পকেটে গেছে বলে ইঙ্গিত দেন তিনি।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আইএফআইসি ব্যাংকের ঋণ কীভাবে অনুমোদন হতো বা কারা সেখানে প্রভাব বিস্তার করেছে, এটা তো সবারই জানা। এখন বিষয় হলো, যিনি এসব বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত, তিনি (সালমান এফ রহমান) ইতোমধ্যেই গ্রেপ্তার হয়েছেন, কিন্তু অন্য মামলায়। আমরা মনে করি, তিনি যেসব আর্থিক অনিয়ম করেছেন, সেগুলোর দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করে বিচারের আওতায় আনা দরকার।

বিশেষ করে যেই পাঁচ প্রতিষ্ঠানের নামে এসব ঋণ বের করা হয়েছে, সেগুলো সুবিধাভোগী কারা তা নির্ধারণ করে বিচারের আওতায় আনা দরকার। হয়তো এ ক্ষেত্রে সব টাকা উত্তোলন করা সম্ভব হবে না। তবে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করা দরকার, যাতে আগামীতে কেউ আর এ ধরনের অন্যায় করতে সাহস না পান।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ব্রাইটস্টার বিজনেস ও অ্যালট্রন ট্রেডিং এই প্রতিষ্ঠান দুটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুসরাত রহমান ও রুবাইয়া আল মাসুম ২০২২ সালে কোম্পানি দুটি গঠন করেন। তারা দুজনই সাত থেকে আট বছর ধরে ট্রেডিং, বিতরণ, আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত আছেন বলে উল্লেখ করেছেন তারা। তবে তারা ঋণ আবেদনের সঙ্গে তাদের অভিজ্ঞতার কোনো কাগজপত্র কিংবা প্রমাণ দেখাননি। আমদানি-রপ্তানির কোনো প্রমাণও সরবরাহ করেননি।

নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, এ দুটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব খোলার মাত্র ২০ থেকে ২৭ দিনের মধ্যেই ১৮০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন পায়। অনুমোদন পাওয়ার চার মাসের মধ্যেই ওভার ড্রাফট (ওডি ঋণ) ব্যাংক থেকে তুলে নেওয়া হয়। তখন প্রতিষ্ঠান দুটির ব্যবসায়িক সাফল্য ও ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা যাচাই করা হয়নি। ঋণ প্রস্তাবনায় লিভারেজ রেশিও, অপারেশনাল দক্ষতা ও উপার্জন সক্ষমতা ‘অগ্রহণযোগ্য’ পর্যায়ে রয়েছে। অন্য নির্দেশকগুলো মার্জিনাল পর্যায়ে রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রস্তাবনায় ব্রাইটস্টার কোম্পানিটির ১৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকার সম্পদ রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পরিশোধিত মূলধন মাত্র ১ টাকা। কোম্পানিটি ২০২৩ সালের জুন মাসের নিট মুনাফা প্রাক্কলন করেছে ২৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকা, যা ২০২৪ সালে ৩৮ কোটি ৭২ লাখ এবং ২০২৫ সালে ৪৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা নিট মুনাফা হবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে।

২০২৩ সালের ৩০ জুন কোম্পানিটির নিট সম্পদ ৩০ কোটি ৯৮ লাখ টাকায় দাঁড়াবে বলে উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া ২০২৪ সালে ৬৯ কোটি ৭০ লাখ এবং ২০২৫ সালে ১১৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকায় পৌঁছাবে ব্রাইটস্টারের নিট সম্পদ। একইভাবে অ্যালট্রন ট্রেডিং কোম্পানির নিট সম্পদ ১৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। পরিশোধিত মূলধন মাত্র ১ টাকা। ৩০ জুন, ২০২৩ সালে এই কোম্পানির নিট মুনাফার প্রাক্কলন করে ৩০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।

যা ২০২৪ সালে ৩২ কোটি ৫৪ লাখ এবং ২০২৫ সালে নিট মুনাফা ৩৩ কোটি ২০ লাখ টাকায় পৌঁছাবে। এ ছাড়া কোম্পানিটির নিট সম্পদ ২০২৫ সালে ৯৩ কোটি ৭৯ লাখে পৌঁছাবে বলেও প্রাক্কলন করে কোম্পানিটি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ কোম্পানি দুটির এর আগে কোনো ব্যাংক ঋণ ছিল না। তাই কোম্পানিগুলোর সিআইবি পর্যালোচনা করে রি-পেমেন্ট বিহ্যাভিয়র যাচাই করা যায়নি।

এ দুটি কোম্পানির করা প্রাক্কলনই বাস্তবসম্মত নয় বলে মতামত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, ট্রেডিং ব্যবসায়, বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের বাজারে পণ্যমূল্য নিয়মিত ওঠানামা করে। এ অবস্থায় ব্রাইটস্টারের নিট মুনাফা ২৯ দশমিক ১৫ শতাংশ বাড়বে, তা যুক্তিসংগত নয়। ছাড়কৃত ঋণের সোর্স অব রি-পেমেন্ট হিসেবে কোম্পানিটির পরিচালকদের নিজস্ব উৎসের কথা উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ, ব্যবসায়ের মুনাফা থেকে ঋণ পরিশোধিত হবে না। এভাবে ঋণ প্রদানের নীতি ও অনুশীলন নেই। কোম্পানির পরিচালকদের অন্যান্য ব্যবসার তথ্য যাচাই করে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করা যাবে না।

এদিকে ঋণের বিপরীতে জামানত হিসেবে ১৮২ কোটি ও ১৯৮ কোটি ৫ লাখ টাকা বাজারমূল্যের লিয়েনকৃত শেয়ার উল্লেখ করা হয়েছে। তবে, সেসব শেয়ার সংক্রান্ত কোনো তথ্য দেয়নি কোম্পানি দুটি। দেশের অস্থিতিশীল শেয়ারবাজারে মুহূর্তেই শেয়ারের দাম কমে যায়। অন্যদিকে, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের বাজারেও পণ্যের দাম নিয়মিত বাড়ে-কমে। এ অবস্থায় অনেক ক্ষেত্রেই পণ্য স্টক লট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ব্যবসাটি ঝুঁকিপূর্ণ। এ ধরনের ব্যবসা তীব্র প্রতিযোগিতামূলক হওয়ায় তাতে একটি নতুন প্রতিষ্ঠান বাজারে টিকে থাকাই কঠিন। তা ছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিজ্ঞতা নিতান্ত শূন্য বলে মন্তব্য করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এসব বিষয়ে জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মনসুর মোস্তফার সঙ্গে। একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি। তবে ব্যাংকটির একটি সূত্র বলেছে, প্রতি নির্বাচনের (জাতীয় নির্বাচন) আগে এমন নামে-বেনামে হাজার কোটি টাকা বের হয়ে যায়। পরে এসব কোম্পানির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। এর আগে ২০১৮ সালেও অস্তিত্বহীন তিনটি কোম্পানি ১ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা বের করে নিয়ে যায় ব্যাংকটি থেকে। সূত্র: কালবেলা