দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও স্টক এক্সচেঞ্জের অংশীদারদের মধ্যে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পক্ষ থেকে ডিএসইতে সাত স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগকে কেন্দ্র করে এ বিতর্ক তৈরি হয়েছে। মুলত গত ১ সেপ্টেম্বর বিএসইসির পক্ষ থেকে ডিএসইর পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়। ওই দিন কমিশন সভায় ডিএসইতে সাত স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়।

এতে ডিএসইর স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন সংস্থাটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও মালদ্বীপ ইসলামি ব্যাংকের চেয়ারম্যান কে এ এম মাজেদুর রহমান, আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মহাপরিচালক মো. কামরুজ্জামান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নাহিদ হোসেন, সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মফিজুল ইসলাম রাশেদ,

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির বিভাগের অধ্যাপক ও সিরডাপের গবেষণা পরিচালক মো. হেলালউদ্দিন, মেটলাইফ বাংলাদেশের সাবেক মহাব্যবস্থাপক সৈয়দ হাম্মাদুল করীম ও বাংলাদেশ ডাটা সেন্টার ও ডিজাস্টার রিকভারি সাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইসহাক মিয়া।

তবে ১ সেপ্টেম্বর এই সাতজনকে নিয়োগ দেওয়া হলেও দুই সংস্থার মধ্যে এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হওয়ায় নবনিযুক্ত পরিচালকেরা এখনো দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। স্টক এক্সচেঞ্জের মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনা পৃথক্করণ বা ডিমিউচুয়ালাইজেশন আইন অনুযায়ী, ডিএসইর স্বতন্ত্র পরিচালক নির্ধারণের দায়িত্ব সংস্থাটির নমিনেশন অ্যান্ড রেমুনারেশন কমিটির (এনআরসি)।

কিন্তু গত ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পুনর্গঠিত বিএসইসির মৌখিক নির্দেশনায় ডিএসইর গত পরিচালনা পর্ষদের স্বতন্ত্র পরিচালকেরা পদত্যাগ করেন। এতে এনআরসি কমিটি অকার্যকর হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে নতুন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। যদিও এ নিয়োগের জন্য ডিএসইর পক্ষ থেকে নাম প্রস্তাব করা হলেও সেই তালিকা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এ কারণে ডিএসইর অংশীদারদের মধ্যে এ নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।

এরই মধ্যে ব্রোকারেজ হাউসের মালিকদের সংগঠন ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশন বা ডিবিএর পক্ষ থেকে নতুন নিয়োগ পাওয়া কয়েকজন স্বতন্ত্র পরিচালকের বিষয়ে আপত্তি তোলা হয়েছে। এমনকি একজনের বিষয়ে বিএসইসির পক্ষ থেকেও সরকারের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।
ফলে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ নিয়ে দুই সংস্থার মধ্যে বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয়েছে পুনর্গঠিত বিএসইসির নবযাত্রার শুরুতে। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এটিকে সার্বিকভাবে বাজারের জন্য সুখকর নয় বলে মনে করছেন। তাঁরা বলছেন, দ্রুতই নতুন করে এ বিষয়ে সমঝোতার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। কারণ, এ ধরনের বিতর্ক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ভুল বার্তা দেয়।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডিএসইর বিগত পর্ষদের স্বতন্ত্র পরিচালকদের পদত্যাগের পর সংস্থাটির পর্ষদে বড় ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়। পাশাপাশি আইনি জটিলতাও দেখা দেয়। এ অবস্থায় স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের জন্য ডিএসইর পক্ষ থেকে নাম চায় বিএসইসি। বিএসইসির প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ডিএসইর পক্ষ থেকে সাতজনের নাম জমা দেওয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই তালিকা থেকে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এমনকি ডিএসইর প্রস্তাবিত ওই তালিকা বাদ দেওয়ার বিষয়ে সংস্থাটিকে কিছু জানানোও হয়নি। এ নিয়ে ডিএসইর মালিকানার অংশীদারদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়।

এদিকে বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ বিতর্ক পারস্পরিক সমঝোতা ও আলোচনার ভিত্তিতে সমাধান করতে হবে। বিএসইসির পক্ষ থেকে এককভাবে ডিএসইর ওপর নতুন পর্ষদ চাপিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি যথাযথ হয়নি। বাজারের স্বার্থেই বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আস্থায় নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতিও যথাযথ সম্মান দেখাতে হবে ডিএসইসহ বাজার অংশীজনদের। পারস্পরিক আস্থা ও সম্মান ছাড়া শেয়ারবাজারের মতো স্পর্শকাতর একটি জায়গায় এককভাবে কোনো কাজ করে সফল হওয়া যাবে না।

এ বিষয়ে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ নিয়ে শুরুতেই বিতর্ক তৈরি হওয়াটা বাজারের জন্য অপ্রত্যাশিত। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত ছিল পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া। আমি মনে করি, এখনো দুই পক্ষ মিলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ পরিস্থিতির সমাধান সম্ভব। দুই পক্ষকে নিজেদের ইগো ভুলে সমঝোতার মাধ্যমে নতুন করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে বাজার অংশীজনদের আস্থায় নিয়েই কাজ করতে হবে। আর নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতিও সম্মান দেখাতে হবে অংশীজনদের।

২০১০ সালের পুঁজিবাজারে ধসের পর খ্যাতনামা ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ২০১৩ সালের নভেম্বরে ডিএসই ও সিএসই ডিমিউচুয়ালাইজড এক্সচেঞ্জ হিসেবে যাত্রা শুরু করে। এর পর থেকে স্টক এক্সচেঞ্জ পরিচালিত হয়ে আসছে স্বতন্ত্র পরিচালকদের নেতৃত্বে। ডিমিউচুয়ালাইজেশন আইন অনুযায়ী, ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদ ১৩ সদস্যের।

এর মধ্যে স্বতন্ত্র পরিচালক মোট সাতজন। এর বাইরে সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হন চারজন শেয়ারধারী পরিচালক, কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের প্রতিনিধি হিসেবে রয়েছেন একজন পরিচালক। আর সংস্থাটির এমডি পদাধিকারবলে পর্ষদের সদস্য।

এদিকে বিএসইসির পক্ষ থেকে নতুন যে সাতজন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে তিনজনের নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে দুজন ডিএসইর সদস্যভুক্ত দুটি ব্রোকারেজ হাউসের পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন স্বতন্ত্র পরিচালক ও মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবে। আর অন্যজন অর্থ মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।

ডিমিউচুয়ালাইজেশন স্কিম অনুযায়ী, ডিএসইর কোনো ব্রোকারেজ হাউস বা কোনো শেয়ারধারী বা পরিচালকের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তি সংস্থাটির স্বতন্ত্র পরিচালক হওয়ার অযোগ্য বিবেচিত হবেন, যদি ওই পদ থেকে তাঁর পদত্যাগের তিন বছর অতিবাহিত না হয়। কিন্তু নতুন নিয়োগ পাওয়া দুজন  পরিচালকের ক্ষেত্রে এ বিধানের ব্যত্যয় হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ডিবিএ।

অন্যদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ডিএসইর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় জড়িত রয়েছে। তাই মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তা সংস্থাটির পরিচালনায় যুক্ত থাকলে তাতে স্বার্থের সংঘাত তৈরির আশঙ্কা থাকে। এ কারণে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে সরকারের কোনো প্রতিনিধিকে ডিএসইর পর্ষদে যুক্ত না করাই শ্রেয় মনে করেন বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী।